প্রাণীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া কাম্য

36

লিটন দাশ গুপ্ত


কয়দিন আগে মোহাম্মদ কাউছারুজ্জামান এসে আমাকে বলেছিল, ‘স্যার আর কোনদিন অফিসে ইঁদুর এসে কাগজপত্র কাটবেনা।’ উল্লেখ্য প্রতিষ্ঠানের ইঁদুরগুলো এতই চালাক; বিষটোপ দিলে খায়না, ফাঁদ বসালে যায়না। অথচ প্রতিদিন প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কেটে টুকরো টুকরো করে নষ্ট করে দেয়। তাই খুশী হয়ে কাউছার থেকে এর কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘গত রাতে কোন রকমে ইঁদুর একটা ধরে ফেলি। এরপর মুখ সেলাই করে ছেড়ে দিয়েছি।’ কাউছারুজ্জামান মানে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। তাই আমি কৌতুহল হয়ে তার থেকে আরো বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, কাউছারকে সমর্থন করে কয়েকজন শিক্ষক সহকর্মী আমাকে সমস্বরে বলে, ‘স্যার বিষয়টি একদম সত্যি।’ ছোটবেলা থেকে নাকি তাঁরা এমনটা শুনে আসছে; এমনকি দাদাদাদী থেকে এর সত্যতার প্রমাণও পেয়েছে! অবশেষে বুঝতে পারলাম এবং নিশ্চিত হলাম, বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত যে একটা কথা বা প্রথা রয়েছে, এটি এখনো অনেকেই বিশ্বাস করেন। অর্থাৎ ইদুঁরের উপদ্রব থেকে রেহাই পাবার জন্যে একটি ইঁদুর ধরে মুখ সেলাই করে, যদি এলাকায় ছেড়ে দেয়া যায়, তাহলে নাকি অন্য ইদুঁর তা দেখে ভয়ে আর আসে না!
মাস কয়েক আগের কথা। পত্রিকায় পড়েছি, ভারতের উত্তর প্রদেশের মনোজকুমার নামে জনৈক ব্যক্তি একটি ইঁদুরকে লেজের সাথে ইটের টুকরো বেঁধে পানিতে ফেলে দিতে গেলে, বিকেন্দ্র শর্মা নামে অপর এক ব্যক্তি এমন নিষ্ঠুরভাবে ইদুঁরটিকে না মারার জন্যে অনুনয় বিনয় ও অনুরোধ করতে থাকে। একপর্যায়ে অনুরোধ বাকবিতন্ডা ও ঝগড়ায় রূপান্তরিত হয়। তারপরেও বিক্ষুব্ধ মনোজ কুমার ইঁদুরটির লেজে ইটের টুকরো বেঁধে, একটি কর্দমাক্ত ডোবার পানিতে ফেলে দেয়। বিকেন্দ্র শর্মা ডোবা থেকে অনেক কষ্টে খুঁজে নিয়ে উদ্ধার করে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে ইঁদুরটি মরে যায়। এরপর বিকেন্দ্র শর্মা ক্ষুব্ধ হয়ে থানায় ইঁদুর হত্যার মামলা করলে, পুলিশ মনোজ শর্মাকে জিজ্ঞাসা বাদের জন্যে গ্রেফতার করে। এইদিকে আদালতের নির্দেশে মৃত ইঁদুরটিকে ময়নাতদন্ত করার জন্যে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পুলিশের এক উদ্ধর্তন কর্মকর্তা জানান, ময়না তদন্তে হত্যার রিপোর্ট এলে আইন অনুযায়ী অপরাধীর যথাযথ শাস্তি হবে। এটি কয়েকমাস আগের ভারতের ঘটনা। কিন্তু কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে ঢাকার রামপুরা এলাকায় ছিদ্দিক মিয়া নামে জনৈক নিরাপত্তা কর্মী, বেশ কয়েকটি জীবন্ত কুকুরের ছানা বস্তায় বেঁধে মাটিতে গর্ত করে চাপা দেয়। এটি দেখে রাকিবুল হক নামে একজন প্রাণীর প্রতি সহানুভুতিশীল ব্যক্তি মামলা করে। বিচারকার্য শেষে বিজ্ঞ আদালত অভিযুক্ত ছিদ্দিক মিয়াকে অর্থদÐসহ ছয়মাসের কারাদÐ প্রদান করে। এইদিকে বছর দুয়েক আগে বরগুনায় একটি মাছরাঙা পাখি হত্যার মামলা করা হয়েছিল, যা আদালতে এখনো বিচারাধীন রয়েছে।
আমি পেশায় শিক্ষক হলেও পক্ষান্তরে একজন আইনজীবী হিসাবে আইন বিষয়ে লেখাপড়ায় জেনেছি, বিভিন্ন প্রকার আইনে পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাণীক‚ল রক্ষার কথা বলা আছে। ১৯৭৩ সালে প্রণীত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন রয়েছে। যা ২০১২ সালে সংশোধন করে অপরাধীর এক বছরের জেল ও পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ২০২০ সালে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিরোধ আইন করা হয়েছে। যেখানে ৪(খ) ধারায় উল্লেখ আছে, জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, যেমন- কোন প্রাণীকে কেউ যদি এমনভাবে বেঁধে রাখে, তাহলে ঐ প্রাণী যদি যন্ত্রনা বা কষ্ট ভোগ করে, তবে এই অপরাধের জন্যে অপরাধীর অনূর্ধ্ব ৩ মাস কারাদÐ বা ১০০ টাকা জরিমানা বা উভয়দÐে দÐিত হবে। এছাড়া আরো বেশকিছু নতুন পুরাতন আইন রয়েছে, যার মাধ্যমে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় বা সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় এনে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া যায়। অন্যদিকে সংবিধানেও জীববৈচিত্র্য পরিবেশ বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার কথা বলা আছে।
তারপরেও দেখছি, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নিঃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে ইদুঁর কুকুর বিড়াল শেয়াল ইত্যাদি প্রাণী। এছাড়া ধান বা অন্যান্য শস্য সব্জীর ক্ষেতে, বৈদ্যুতিক তার দিয়ে মারা হচ্ছে বন্য হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী। আবার সাপ গুইসাপ বেজি কিংবা নানান জাতের প্রাণী খুঁজে খুঁজে ধরে এনে মারা হচ্ছে। কুসংস্কার বশে জলন্ত আগুনে জীবন্ত সাপ পুড়ে ফেলা হচ্ছে। এমনকি পশুর লেজ পা কিংবা পাখির ডানা পাখা ইত্যাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে দিয়ে আনন্দ করছে। কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, একদল শিশু ফড়িং আর প্রজাপতি ধরে লেজের সাথে ‘বাডিয়া’ নামে একপ্রকার চিকন ঘাস (চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঐ ঘাসকে বাডিয়া বলা হয়) লাগিয়ে আকাশে উড়োজাহাজের মত উড়িয়ে আনন্দ করছে। আরো বেশ কিছুদিন আগে দেখেছি পথের একপাশে নিরাপদে থাকা একটি কুকুর ছানাকে, এক রিক্সা চালক ইচ্ছাকৃতভাবে গায়ের উপর চালিয়ে মারাত্বক আহত করে চলে গেছে। দেখেছি, বিড়ালের গলায় দড়ি বেঁধে রাস্তায় টেনে টেনে ‘বানরের গণাপড়া’ বলে খেলছে একদল শিশু। এইসব ঘটনাগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ স্বচক্ষে দেখে আসছি। অহরহ এমন নিষ্ঠুর ভাবে প্রাণী হত্যা বা আহত করার দৃশ্য কিশোরদের মাঝে বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে করে যেমনই প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে বা বিলুপ্ত ঘটছে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে; তেমনই ছোটছোট শিশু কিশোরদের মধ্যে সন্ত্রাস খুন হত্যা করার মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে, একইসাথে তারা নিষ্ঠুর নির্দয় ও অমানবিক হয়ে একটি প্রজন্ম হিসাবে বেড়ে উঠছে।
প্রাথমিকস্তরের ৩য় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের ‘জীবে দয়া’ নামে পাঠের এক অনুচ্ছেদে লেখা আছে, হাটবাজার থেকে হাঁসমুরগী কিনে এদের একসাথে পা বেঁধে, মাথা নিচের দিকে রেখে বাড়িতে আনতে গেলে, প্রাণীদের খুব কষ্ট হয়, ব্যথা পায়। এমন কাজ অন্যায় বলে উল্লেখ করে, শিশু শিক্ষার্থীদেরকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সনাতন ধর্মে আছে ‘যত্র জীব তত্র শিব’। অর্থাৎ প্রাণীর মধ্যে ¯্রষ্টা সর্বদা বিরাজমান। এই বিষয়ে প্রায় প্রতিটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বিশদভাবে বলা আছে। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের কথা তো সকলের জানাই আছে ‘জীব হত্যা মহা পাপ’ যা পঞ্চশীল নীতির অন্যতম একটি। অন্যান্য ধর্মেও হয়তো এমনই আছে। এছাড়া একদিন এক সাহাবি মা পাখি থেকে বাচ্ছা ছিনিয়ে আনা দেখতে পেয়ে, মহানবী (সা.) মা পাখিটির আর্তনাদ উপলব্ধি করতে পেরে বাচ্ছাগুলোকে মায়ের কাছে রেখে আসতে বলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রকার আইনে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণী হত্যার শাস্তি আছে, প্রাণীদের প্রতি সহানুভুতিশীল হবার জন্যে প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার কথা সংবিধানের ১৮(ক) নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে। কিন্তু তারপরেও নিরপরাধ প্রাণীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে, শাস্তি দেয়া হচ্ছে, আঘাত করা হচ্ছে। এখানে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারে, আধ্যাত্বিক জগতের বেশীরভাগ ধর্মে প্রাণী হত্যার বিধান রয়েছে। এই প্রসঙ্গে বাস্তব এক কথা না বললে নয়।
নিষ্ঠুরভাবে প্রাণী হত্যার প্রসঙ্গে জনৈক পরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, তিনি সরাসরি বলেই ফেললেন হিন্দুধর্ম এবং ইসলাম ধর্মে ব্যাপক ভাবে প্রাণী হত্যা করা হয়। আমি ধর্মের বিষয় বা বিষয়বস্তুতে যাচ্ছিনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেও মাংসাশী প্রাণী! অর্থাৎ নিরামিষ ভোজী নয়। তাছাড়া আইনেও ধর্মীয়ভাবে প্রাণী হত্যা বৈধ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে বলছি, নিষ্ঠুরভাবে অযথা প্রাণী হত্যা কিংবা প্রাণীকে আহত করা বা কষ্ট দেয়ার কথাই বলছি। বিষয়টি নিজের শরীরবৃত্তীয়ভাবে অনুভব করেছি বলেই সকলকে বিরত থাকা উচিত মনেকরি।
আর সকলকে উপলব্ধির প্রয়োজন আছে বলেই আজ এখানে উপস্থাপন করেছি। একইসাথে বলতে চাই, নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করে কিংবা ধর্মীয় গ্রন্থে বা শিক্ষাক্রমে উল্লেখ করে সফলতা আসবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ সত্যিকার অর্থে সচেতন হবেনা। আমাদের নিজের দেহ ও মনের সাহায্যে অনুভব করতে হবে, সকল প্রাণীর দেহ ও প্রাণ একই। সকল প্রাণীর মানুষের মত সুখ দুঃখ অনুভব করার ক্ষমতা আছে। এই অবস্থায় সরকার পরিবেশবাদী সংগঠন, পশুপাখি প্রেমী ব্যক্তিসহ সকলকে অযথা নিষ্ঠুরভাবে প্রাণী হত্যা কিংবা প্রাণীর উপর অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ প্রতিরোধে আরো বেশী ভাবতে হবে, আরো বেশী সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও সাহিত্যিক