মোহাম্মদ ইউসুফ
দু’মাস গত হলেও চলমান ভয়াবহ জীবনবিধ্বংসী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রক ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি। সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগের অভাবে করোনা প্রতিরোধ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাছাড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন তৈরি করেছে সেখানে করোনা আক্রান্ত মৃতদেহের অটোপসি করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না করায় নতুন এ রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকেরাও পরিস্কার ধারণা পাচ্ছেন না। এতে করে করোনা রোগীরা প্রকৃত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
করোনাভাইরাস তার মরণকামড় অব্যাহত রেখেছে। করোনায় আক্রানমশ ও মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এ পর্যন্ত (১১মে ২০২০) ২৩৯জন মারা গেছে এবং ১৫হাজারেরও বেশি আক্রান্ত হয়েছে। সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না মানুষ। বিনাচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে সাধারণ রোগীরা। করোনার নেগেটিভ সনদ ছাড়া সাধারণ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে পথেই মারা যাচ্ছে অনেকেই।করোনার জন্যে নির্ধারিত হাসপাতালগুলো এখনও পর্যন্ত চিকিৎসার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, পরীক্ষার কীট, ল্যাব ও দক্ষ জনবল সঙ্কট লেগেই আছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাব্যবস্থা না থাকায় ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, পুলিশ, সাংবাদিকও মৃত্যুবরণ করছেন। সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মেজর জেনারেল আনোয়ারুল কবির, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ গণ্যমান্য অনেকেই মৃত্যুবরণ ও আক্রান্ত হচ্ছেন। জীবন ও জীবিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে দেশের মানুষ। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণসামগ্রী চুরিও চলছে।ইতোমধ্যে ৫৪জন ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার চুরির দায়ে বহিস্কৃত হয়েছে।আবার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকের বোরো ধান কেটে দেয়ার বিরল দৃশ্যও দেশবাসীর নজর কাড়ছে। করোনার ভেকসিন বা ওষুধ আবিস্কারের প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে কয়েকটি দেশের বিজ্ঞানাগারে। আশার আলো যে নেই তা নয়।কয়েকমাসের মধ্যে সফলতার সুখবর বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
করোনা প্রতিরোধে আমাদের তথাকথিত লকডাউন ও ঘরে থাকার নির্দেশ শিথিল হতে চলেছে। মূল যে পদক্ষেপগুলো যেমন, হাতধোয়া, সামাজিক (শারীরিক) দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলা-এসব শিথিল করা হয়নি। মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত পদক্ষেপও(রোগীর সন্ধ্যান, পৃথকীকরণ, পরীক্ষা ও সব রোগের চিকিৎসা)শিথিল করা হচ্ছে না। এসব ব্যবস্থা শুরু থেকেই কঠোরভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।কিছু মানুষ বিধিবিধান উপেক্ষা করে আসছে সবসময়।ঘরে থাকতে অনেকেরই চরম অনীহা। তাদের ধারণা, বাংলাদেশে করোনায় ব্যাপক মানুষ মারা যাবে না। অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখলে মানুষ অন্তত না খেয়ে মারা যাবে না। সরকার নিয়ন্ত্রণ শিথিলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গার্মেন্টসসহ দেশের সকল কলকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হয়ে গেছে। গণপরিবহণও হয়তো চালু হয়ে যেতে পারে। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক সময়ের মতো হয়ে গেছে প্রায়। সবাই যে স্বাস্থ্যবিধি মানছে-তা নয়।
করোনা নিয়ে দেশে কথামালার রাজনীতিও আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতিযুদ্ধ চলছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও তথ্যমন্ত্রী ওবায়দুল হাছান মাহমুদ বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছেন। বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কোথাও নেই, আছে শুধু টেলিভিশনে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সকল কাজ একাই করতে হচ্ছে। গণভবনে বসে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।সববিষয়ে যদি প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়, তাহলে জনগণের টাকা খরচ করে এতবড় মন্ত্রীসভা পোষার দরকার কী? জাতির এ মহাদুর্যোগে করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে দল মতের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশের বিভিন্ন পেশার প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা খুবই জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশি-বিদেশি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় টেস্ট টেস্ট টেস্ট ও আইসোলেশান আইসোলেশান আইসোলেশান বলে গলা শুকিয়ে ফেললেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের কানে তা ঢুকছেই না। করোনা মোকাবেলায় তারা দ্রæততার সাথে সময়োপযোগী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। করোনা রোগী শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে এ মুহূর্তে বিপুলসংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া জরুরি হলেও এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো কোনো তৎপরতা নেই।চাহিদা দেড়লাখ হলেও আছে মাত্র ৫হাজার টেকনোলজিস্ট। অথচ একজন চিকিৎসকের বিপরীতে ৫জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা বাঞ্চনীয়। দেশে ৪০ হাজার পাসকরা প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার থাকলেও তাদের এডহকভিত্তিতে কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দিনদিন করোনা সংক্রমণের হার বাড়লেও নমুনা পরীক্ষার হার হতাশাজনক।লোকসংখ্যা অনুপাতে বর্তমানে দৈনিক ২০হাজার লোকের পরীক্ষা করার কথা থাকলেও সেখানে ৭/৮হাজারের বেশি করা যাচ্ছে না।দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে যেখানে পিসিআর মিশিন আছে সেখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও আনুষঙ্গিক উপকরণ যোগান দিয়ে দ্রæততার সাথে করোনার নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো দরকার হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রক ও অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা তা উপলব্ধি করতে পারছে না। এছাড়া দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে একশো’র মতো ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি আছে। মন্ত্রণালয় তো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংগ্রহকেন্দ্র স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে করোনা নমুনা পরীক্ষার কাজে সম্পৃক্ত করতে পারে।
অন্যদিকে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধান হচ্ছে না।ফলে, জানা যাচ্ছে না প্রাণঘাতী ভাইরাসটি মানবদেহের কোন কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ক্ষতের সৃষ্টি করছে।আক্রান্তদের শরীরে কী কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, রোগীর কতো ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে, লক্ষণবিহীন রোগী আদৌ আছে কি না-বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় রোগীদের চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।একইসাথে সঠিক ওষুধ নির্ধারণও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দেশের করোনা আক্রান্তদের চিকিকৎসা বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে- সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অথচ সবদেশেই করোনাভাইরাস একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। নিশ্চিত হয়ে রোগ নির্ধারণ এবং চিকিৎসা দেয়ার জন্যে বিভিন্ন দেশে করোনা আক্রান্ত মৃতদেহের অটোপসি (মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধ্যান)হচ্ছে। ময়নাতদন্তের মাধ্যমে ক্ষত, প্রতিক্রিয়া এবং লক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মরদেহ অটোপসি করার বিষয়টি ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস দেশের মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে- সেই সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ চিকিৎসক কিছুই জানতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধু অটোপসি করেই জানা সম্ভব নতুন রোগটি মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। তাই চীন, ইতালী, ব্রাজিল, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে করোনা আক্রান্তদের মৃতদেহে রোগের অনুসন্ধ্যান করে চলেছে। ভারতের কেরালা রাজ্যে ও শ্রীলংকাতেও এটি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা গাইডলাইন প্রনয়নের কাজ করেছেন, তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি।দেশের করোনার সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে অবিলম্বে অটোসপি চালুর ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, আমাদের এখানে বলা হচ্ছে, উপসর্গহীন রোগী আসছে- এটা সঠিক নয়। আসলে আমরা নিশ্চিত নই যে, করোনা আক্রান্তদের কত ধরনের উপসর্গ থাকতে পারে। আমরা যেটুকু শুনেছি, সে ধরনের লক্ষণ না থাকলে আমরা বলছি উপসর্গহীন। আসলে লক্ষণ বোঝা যাবে রোগটি মানবদেহে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে তার ওপর। এটা জানতে হলে দেহের ভেতরে দেখতে হবে। এ জন্যে করোনা আক্রান্ত মরদেহ কেটে দেখা দরকার ভাইরাস কোথায় ক্ষত সৃষ্টি করেছে; শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।এ জন্যে কী কী লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। করোনা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে মানুষের ওপর পৃথক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, আমাদের দেশে সেই চিকিৎসা কার্যকর না হওয়ার আশংকা বেশি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে রোগীর লক্ষণ আমাদের দেশের রোগীর মধ্যে দেখা না-ও যেতে পারে। অন্যকোনো উপসর্গ থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তার চিকিৎসাও আলাদা হবে। এতে রোগীটি দ্রæত আরোগ্য লাভ করতে পারে। এ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা কমাতে হলে দেশে এ সংক্রান্ত রোগীর মরদেহে অটোপসি করে দেহের ক্ষত, লক্ষণ, রোগীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভাইরাসটি আমাদের কী ধরনের ক্ষতি করছে, তা আমরা জানি না। মানবদেহে করোনা-ভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে বিষদভাবে জানতে হলে মরদেহে রোগ অনুসন্ধ্যানের প্রয়োজন। মৃতদেহের রোগ অনুসন্ধ্যান ছাড়া রোগ এবং রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই দেশের মানুষের সুচিকিৎসার স্বার্থে করোনা আক্রান্ত রোগীর মরদেহে অটোপসি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি দরকার।
লেখক : প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী
ও চাটগাঁরবাণীডটকম