প্রাচীন প্রথায় ম্রো পাড়া ‘লকডাউনে’

42

বাঁশ দিয়ে পাড়ার প্রবেশপথ বন্ধ; বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না, পাড়ার কেউ বেরও হতে পারবে না। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে যেখানে লোকজনকে ঘরে রাখতে হিমশিম অবস্থা, তখন প্রাচীন এই পদ্ধতিতে নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছে বান্দরবানের আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠী।
বান্দরবান শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের দুর্গম চিম্বুক পাহাড়ের রাংলাই ম্রো পাড়ার প্রবেশমুখে বাঁশের ব্যারিকেডের ছবি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পিছিয়ে থাকা এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর এমন উদ্যোগের প্রশংসাও করেছেন অনেকে। খবর বিডিনিউজের
দুর্গম পাহাড়ে মহামারীর ছোবল নতুন কিছু নয়। ফলে যে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে বাঁশ বা গাছ দিয়ে আদিবাসী পাড়াগুলোর এভাবে ‘সামাজিক লকডাউন’ করার চর্চাও চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। জার্মানির নৃবিজ্ঞানী লুফলা তার গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্য ম্রো’ এ এমন সুরক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ‘লকডাউন’ এবং ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
রাংলাই ম্রো পাড়ার কারবারী (গ্রামপ্রধান) লেংপুং ম্রোর কাছ থেকে জানা গেল প্রাচীন এই ব্যবস্থা সম্পর্কে। তিনি বলেন, “সম্প্রতি একটি ভাইরাসের নাম শুনেছি। ছোঁয়াচে এ রোগটি নাকি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায়। পাড়ার মানুষদের রক্ষা করতে এমন ব্যবস্থা নিয়েছি।
“এক সময় হাম ও বসন্ত রোগে ম্রোদের অনেকেই মারা গেছে। এগুলো মহামারী রোগ। ঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে না পারলে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় ছড়িয়ে যায়। মানুষের যাতায়াত বন্ধ রাখতে বাঁশ অথবা গাছ দিয়ে পথ আটকে রাখা হত।”
“আদিকাল থেকে ম্রো সমাজ এ চর্চা করে আসছে। জরুরি প্রয়োজনে কেউ আসলে ডাক দিতে হবে,” বলেন লেংপুং ম্রো।
ফেইসবুকে ছড়িয়ে রাংলাই পাড়ার ছবিটি ভাইরাল হওয়া এ ছবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম ত্রিপুরা মন্তব্য করেছেন- ‘A mro village of Bandarban, unique example of community Lockdown’
মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী ডনাইপ্রু নেলী লিখেছেন, ‘গতানুগতিক শিক্ষা এদের না থাকলেও জ্ঞানের ভান্ডার কমতি নেই। শহরে সার্টিফিকেটধারী এখনো সচেতন হয়নি অথচ পশ্চাৎপদ ম্রো জনগোষ্ঠী গ্রামবাসীরা তাদের গ্রামকে সুরক্ষিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে’।
‘জেনে ভালো লাগছে যে, এ মহা দুর্দিনে কোথাও কোথাও আমার প্রিয় পাহাড়বাসী তাদের ঐতিব্যহী পাড়াবন্ধ প্রথাকে ফিরিয়ে এনেছে,’ লিখেছেন একটি বহুজাতিক সংস্থার কর্মী কংচাই মারমা।
‘Countrywide Lockdown is the best way to save our lives. পাহাড়ে করোনা আক্রমণ করবে না এটি কোনোভাবে এড়িয়ে যাবেন না’ এমন মন্তব্য করে ছবিটি শেয়ার করেছেন মারমা এ মং নামের একজন।
ঢাকার আহমেদ আমান মাসুদ নামের একজন ম্রো পাড়ার ছবি ফোইসবুকে শেয়ার করে লিখেছেন লিখেছেন, “পাড়াবন্ধ পাহাড়ের একটা অতি প্রাচীন পদ্ধতি। যখনই কোনো ধরনের দুরারোগ্য অথবা ছোঁয়াচে ব্যাধি মহামারী আকারে দেখা দেয় কিংবা সম্ভাবনা তৈরি করে তখন পাহাড়িরা তাদের পাড়া ও নিজেদের স্বার্থে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়।”
ম্রো পাড়ার ছবি নিজেদের ফেইসবুক পেইজে শেয়ার করেছে পরিবশে ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা ওয়াইল্ড ওয়াচ নামের একটি গ্রূপ।
‘আদিবাসীদের মধ্যে সবচাইতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী ম্রো। তারা দেখিয়ে দিল লকডাউন’- তাদের মন্তব্য।
শুধু ‘পাড়াবন্ধ’ করেই বসে থাকেনি এই জনগোষ্ঠী। ২৩ মার্চ থেকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে পাড়ায় পাড়ায় নিজেদের ভাষায় লিফলেটও বিতরণ করছে একদল ম্রো তরুণ।
এর প্রধান উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্র ও লেখক ইয়াঙান ম্রো জানান, বেশিরভাগ ম্রো বাংলা জানে না। সারাদেশে কী হচ্ছে তাদের জানা নেই। করোনাভাইরাসের বিপদ সম্পর্কে সহজে বোঝাতে ম্রো ভাষায় লিফলেট করা হয়েছে।
‘বিভিন্ন ম্রো পাড়ায় তরুণরা লিফলেট বিতরণ করছে, সচেতন করে তুলছে। অনেক দুর্গম এলাকাতেও করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।”
বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য সিংইয়ং ম্রো বলেন, “ইতিমধ্যে ম্রোদের পাড়ায় বাইরের কেউ যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বের হতেও পারবে না। এটি এক ধরনের ম্রো সামাজিক নিয়মে ‘লকডাউন’।
“ছোঁয়াচে মহামারী রোগ দেখা দিলে ম্রোদের এমন সুরক্ষার ব্যবস্থা আদিকালের। বিপদে পড়ে কেউ এসে থাকলেও পাড়ার বাইরে একটি টং ঘরে রাখা হয়। যাতে পাড়াবাসীদের সংস্পর্শে না আসে।”
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, পার্বত্য বান্দরবান জেলায় ম্রো জনসংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ৬৫৬ জন।
অবশ্য সামাজিক সংগঠন ম্রো সোশাল কাউন্সিলের বিভিন্ন সময় করা জরিপে প্রায় ৮০ হাজার জনসংখ্যা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তারা।