পাহাড় আর নদীর ঐশ্বরিক মিলনস্থল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি শহরতলী নামে খ্যাত বোয়ালখালী। দক্ষিণে পটিয়া উপজেলা, পূর্ব প্রান্তে ইতিহাসের সাক্ষী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কড়লডেঙ্গা পাহাড়, উত্তর-পূর্ব দিক থেকে লুসাই পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসা শ্রোতশ্বীনি, রাজ কুমারীর কানের দুল হারিয়ে নাম হয়ে যায় কর্ণফূলী, আঁকা-বাঁকা মেটোপথ ধরে পশ্চিম প্রান্তে বয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশে একাকার।
এরই মাঝে ১৩৭.২৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনজুড়ে মুখথুবড়ে পড়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এক নক্ষত্র বোয়ালখালী উপজেলা। চট্টগ্রাম শহরের খুবই সন্নিকটে হওয়ায় এটিকে অনেকে শহরতলী নামে আখ্যায়িত করে। যদিও বাস্তবে এর চিত্র ভিন্ন। ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে রয়েছে উন্নয়নের দিক দিয়ে।
প্রবাদ ছিল চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদী আর বোয়ালখালীর দুঃখ/অভিশাপ কর্ণফূলী। চীন তাদের এই হোয়াংহো নদীর উপর পর্যাপ্ত সেতু ও নদীর দুই পাড়ে বাঁধ ও পরিকল্পিত নগরায়ন করে এটিকে আর্শিবাদে পরিণত করেছে। কিন্তু দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুঃখ এই নদীর উপর নির্মিত মেয়াদ উত্তীর্ণ জরাজীর্ণ একমুখী কালুরঘাট সেতু, এই একমুখী সেতুর কারণে চট্টগ্রাম শহরের বুক থেকে বোয়ালখালীকে দূরে ঠেলে রেখেছে। থামিয়ে রেখেছে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা।
যাদের জন্মে ধন্য এই ধরণী যারা ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে আছেন, তারা হলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী অগ্নি-যুগের অগ্নি-পুরুষ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী, তারেকশ্বর দস্তিদার, স্যার আশুতোষ কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চট্টগ্রামে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন কানুনগো পাড়া দত্ত পরিবারের সেই রেবতী রমণ দত্ত, জাতীয় রাজনীতিতে অনন্য ভূমিকা রাখা তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন খান বাদল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞানে অশেষ অবদান রাখা বৃটিশ সরকার হতে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞানী ডা. এ কিউ এম হারুন, ডা. আহমদ শরীফ, ডা. শিশির দত্ত, ডা. বিবি চৌধুরী, ডা. মকবুল আহমেদ, একুশে পদক প্রাপ্ত কবিয়াল রমেশ শীল, প্রখ্যাত ঢোল বাদক বিনয় বাঁশী জলদাশ, আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ, বীরঙ্গনা লিখিকা রমা চেীধুরী, আলী আহম্মদ কমিশনার, জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব নুরুল ইসলাম আকবরী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার লেঃ জেনারেল জহিরুল ইসলাম, চৌকস মেধাবী সেনা কর্মকর্তা মেজর জয়নুল আবেদীন চৌধুরী, সাংবাদিকতা জগতের প্রতিকৃত সাংবাদিক নুরুল ইসলাম, চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী কবরী সরোয়ার এর মত আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন সল্প পরিসরে যাদের অনেক কেই স্বরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এমন মহীয়শী প্রাণ পুরুষদের পবিত্র জন্মস্থান আজ ধুঁকে ধুঁকে কাঁদছে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। শুধুমাত্র যোগ্য ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবেই বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে। দেশের অন্যান্য উপজেলারগুলোর উন্নয়ন চিত্র দেখলে স্পষ্টতই অনুমেয় বোয়ালখালীর জনগণ কতটুকু বঞ্চিত রয়েছে। এর জন্য এলাকার সাধারণ নাগরিকরা প্রতিনিয়তই রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৈন্যদশা দায়ী করছে।
বোয়ালখালী উপজেলা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদ এর কিছু অংশ নিয়ে এই এলাকার সংসদীয় আসন। স্বাধীনতার সময়কার এই এলাকার এম,এল,এ ছিলেন ডা. এম.এ মান্নান। মহান স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই এলাকা থেকে ১ম সংসদ সদস্য হন আওয়ামীলীগের এম. কফিল উদ্দিন। তিনি তখনকার প্রেক্ষাপটে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। এর পর ১৯৭৯ সালে ২য় সংসদ সদস্য বিএনপি সিরাজুল ইসলাম। তিনি ঐ সময়ে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কালুরঘাট-ভান্ডলজুড়ি সড়ক নির্মাণ। এর পর ১৯৮৬ ৩য় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মোরশেদ খান। তিনি স্যার আশুতোষ কলেজ সরকারিকরণঃ করণে ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৮ সালে ৪র্থ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কামরুন্নাহার জাফর। তিনি ঐ সময়ে উল্লেখযোগ্য কোন কাজ করেননি। ১৯৯১ সালে ৫ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয় সিরাজুল ইসলাম- এই সময় তিনি প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো পাকা দালান নির্মাণে ও গ্রামীণ সড়ক সংষ্কারে ভূমিকা রাখেন।
১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারী ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মোরশেদ খান, ১৯৯৬ সালে ১২ জুন ৭ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে বিএনপি থেকে বিরোধী দলীয় সাংসদ হন মোরশেদ খান। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য কোন কাজ দেখাতে পারেননি তিনি। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এই এলাকার ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হওয়ার পরেও এলাকার উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকাই রাখেননি। তার নির্বাচনে ইস্তাহারে জনগণকে দেওয়া কোন প্রতিশ্রুতি তিনি বাস্তবায়ন করেননি। এই সময় অল্প-স্বল্প যা উন্নয়ন হয়েছে তা ঐ সময়কার সরকারের চলমান উন্নয়ন অংশ। সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার পরেও জনগণের প্রাণের দাবি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ সম্পর্কে কোন কথায় বলেন নি। তিনি দায়িত্ব নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন প্রকল্প গ্রহণ করেন নি। মন্ত্রীর এলাকার জনগণ হিসেবে প্রত্যাশা চেয়ে প্রাপ্তির ব্যাপক পারাক থাকায় হতাশায় জনগণ মোরশেদ খান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ১/১১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পট পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রতীক নিয়ে চৌদ্দ দলীয় জোট প্রার্থী (জাসদ) বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিন খান বাদল নির্বাচিত হয়ে সর্বপ্রথম এই অঞ্চলের জনগণের প্রাণের দাবি কালুরঘাট সেতু নির্মাণের গুরুত্ব ও দাবি জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি পর পর ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়। সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন কালে উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে- কর্ণফুলীর পাড়ে কালুরঘাট এলাকায় আন্তর্জাতিক মানের মেরি-টাইম ইউনিভার্সিটি স্থান নির্ধারণ, সিএন্ডবি রাস্তায় মাথায় এক হাজার ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন মহিলা হোষ্টেল নির্মাণ, ষোলশহর এলাকায় টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ, বোয়ালখালী অংশে ফুলতলা থেকে কানুনগো পাড়া সড়ক খালের গাইড ওয়াল নির্মাণ সহ প্রসস্থ করণ, কর্ণফুলীর ভাঙ্গণরোধে ব্লক নির্মাণ, ফায়ার বিগ্রেড নির্মাণ, কানুনগো পাড়া থেকে মুখুন্দরাম হাট সড়ক সম্প্রসারণ সহ গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট পাকা অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্প জাতীয় একনেক কমিটিতে উপস্থাপনের পরেও উচ্চতা জটিলতার সমস্যায় বিআইডব্লিউটিএ আপত্তির কারণে পূনঃ সংশোধনকল্পে ফেরত আসে। শেষ পর্যন্ত ঐ দাবিতে সোচ্চার মঈন উদ্দিন খান বাদল একাদশ সংসদ চলাকালীন ২০১৮ সালের ৭ই নভেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চির বিদায় নেন। ২০২০ সালের একাদশ জাতীয় সংসদের এই আসনে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। উনি ২০২০ সালে ১৩ই জানুয়ারিতে উপ-নির্বাচনে ঘোষণা দেন- নির্বাচিত হতে পারলে একবছরের মধ্যে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের। কিন্তু…………….?
যুগের পর যুগ এভাবে প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে মানুষ রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সাধারণ মানুষ তাদের আর বিশ্বাস করতে চায় না। নির্বাচন আসলে তাদের কথার ফুলঝুড়িতে আর মানুষের মন ভরে না। মানুষ এখন বাস্তববাদী। তাই অনেকে ভোট কেন্দ্র এড়িয়ে চলে। ভোট দানে অনাস্থা লক্ষ্য করা যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে।
৩ লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষগুলোর চাহিদা খুবই সামান্য, যা চোখ মিললেই দেখা যায়।
১) ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত মেয়াদ উত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতুর পার্শ্বে নতুন একটি সড়ক কাম রেল সেতু নির্মাণ করা।
২) কালুরঘাট হতে নতুন শাহ আমানত ব্রীজ পর্যন্ত বোয়ালাখালী অংশে নদীর পাড় ঘেষে একটি সার্কুলার লিংক রোড নির্মাণ করা। তৎসংলগ্ন এলাকায় পরিকল্পিত শিল্পায়ন গড়ে তোলা।
৩) বোয়ালখালীর পূর্বে পাহাড়ী অঞ্চলে তিন ধর্মের মানুষের মিলনস্থল হযরত বু-আলী কালন্দর শাহ (রা:) মাজার, মেধাসমণি আশ্রম, বৌদ্ধদের তীর্থস্থান মিলে সম্মিলিত পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা।
৪) কালুরঘাট সেতু থেকে রেল সড়কের পাশাপাশি অর্ধ নির্মিত সড়ক সেতু গোমদন্ডী-বেঙ্গুরা
হয়ে ধলঘাট পর্যন্ত পুরোপুরি রূপে চালু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করণ।
৫) বোয়ালখালীর জৈষ্ট্যপুরা নদী-পাহাড়ের পাদদেশ পরিকল্পিত অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা।
৬) আধুনিক কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আই.টি. ভিলেজ গড়ে তরুণ ও যুব সমাজকে ইনফরমেশন টেকনলজি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করা।
সর্বোপরি শহরতলী নামে খ্যাত এই জনপদকে পরিকল্পিত উপ-শহর হিসেবে রূপান্তরের পদক্ষেপ নেওয়া।
অথচ নির্বাচন আসলে নেতারা সব সমস্যা সমাধান করে দিবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। কেউ বলে ১ বছরে কালুরঘাট সেতু, ২ বছরে শিল্পাঞ্চল, ৩ বছরে উপ-শহর … আরো কত কি? নেতাদের মন ভুলানো কথায় সাধারণ মানুষ তাদের অতীত ভুলে যায়। আমার কথা হচ্ছে ভোট চাইতে হবে কেন? জনগণের জন্য কাজ করলে জনগণ এমনিই ভোট দিবে। টাকা দিয়ে ভোট কেনা-অথবা পেশী শক্তি দিয়ে ভোট আদায় করার চেয়ে লজ্জাজনক হলো ধোঁকাবাজি করে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ভোট আদায় করা। মনে রাখা উচিত প্রতি পাঁচ বছর পরইতো নির্বাচন। আমাদের দেশে যারা তথাকথিত নেতা দাবি করেন তারা যদি একবারও ভাবতো দেশ ও জনগণের স্বার্থে কিছু করা যায় কিনা? তাহলে এসব সমস্যা হয়তো থাকতো না। আজ বোয়ালখালীর আপামর জনসাধারণের দাবি এমন কেউ উঠে আসুক যার মধ্যে দেশাত্মবোধ আছে, এলাকার মানুষের জন্য কিছু করা যার পক্ষে সম্ভব। অবহেলিত এই জনপদকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা ও মানসিকতা রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, আইনজীবী