প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাস সংরক্ষণে নগর মিউজিয়ামের প্রয়োজনীয়তা

87

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

বিশ্ব জাদুঘর দিবস আজ। এই দিবসটি উপলক্ষে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের স্মারকসমূহ সংরক্ষণ ও সংস্কারপূর্বক চট্টগ্রাম নগরীতে একটি ‘নগর মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করা ইতিহাস সচেতন চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী। অযত্নে-অবহেলায় এই চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী প্রথম স্মারকগুলো ধ্বংস হতে চলেছে। এই ব্যাপারে চট্টগ্রামবাসীর আশা- বাংলাদেশ সরকার নগর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাসকে তুলে ধরার উদ্যোগ নেবেন। বলা হয়- একটি জাদুঘর হাজার হাজার বছর পরও জাতির ইতিহাস প্রজন্মের সামনে উপহার দেয়। সেক্ষেত্রে জাদুঘরের ভূমিকা অপরিসীম। এবারের বিশ্ব জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘জাদুঘরের ভবিষ্যত :পুনরুদ্ধার করুন এবং কল্পনা করুন’। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম (আইসিওএম) এই প্রতিপাদ্য নির্বাচন করে।
সভ্যতার ইতিহাসকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সমগ্র বিশ্ব জাদুঘর দিবস পালন করে আসছে। অতীতের সোনালী কিংবা ব্যর্থতা যাই হোক তা সহজ সরল ও বস্তুনিষ্ঠুভাবে মিউজিয়াম কিংবা যাদুঘরে সংরক্ষিত হয়। সেই মিউজিয়াম থেকে জাতি তার অতীত ইতিহাস জানেন। উন্নত প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া বিশ্ববাসী এ দিবসটি মহা আনন্দের সাথে পালন করে। আমাদের বাংলাদেশে খুবই গুরুত্বহীনভাবে দিবসটি পালিত হয়।
চট্টগ্রামকে বলা হতো হাজার বছরের চট্টগ্রাম। বিশ্বে আলোচিত প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতের বিভিন্ন শ্লোকে আদিনাথ, চন্দ্রনাথ ও কাঞ্চননাথের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। আর সেই আদিনাথ, কাঞ্চননাথ ও চন্দ্রনাথের অবস্থান চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, ফটিকছড়ি ও কক্সবাজারের মহেশখালীতে। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ তিন স্মৃতির স্মারক অযত্নে-অবহেলায় ধ্বংসের প্রহর গুনছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাস গবেষণায় গবেষকদের প্রাপ্ত অনুসন্ধানী তথ্য-উপাত্তে¡ প্রমাণিত হয়েছে- এ প্রাচীন চট্টগ্রামে আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে মানববসতি ছিল (!)। প্রাচীন এ চট্টগ্রামবাসীর ইতিহাস-ঐতিহ্য সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলছে বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে। হয়তো ইতিহাস গবেষকদের মেধা ও মননযুক্ত আলোচনা ও গবেষণায় একদিন বিশ্ব দরবারে গৌরবের আসনে বসবে এই চট্টগ্রাম। রাষ্ট্রের সার্বিক সহযোগিতা ও সংরক্ষণের উদ্যোগবিহীন এ ইতিহাসের স্মারক রক্ষা অসম্ভব। আমাদের দেশে ইতিহাস সচেতনতা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনেক প্রাচীন প্রত্নসম্পদ বা প্রাচীন স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখনও তা চলমান। এ বিষয়ে সরকারি আইনও সীমাবদ্ধ। আইনের দুর্বলতার কারণে অনেক ভূমিদস্যু প্রাচীন সম্পদ নষ্ট করে অবৈধ ভূমি দখল করে অন্য কিছু তৈরি করছে। একটি জাতির ইতিহাস হত্যাকারীর বিচারের সাজাও অতি নগণ্য।
বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ চিন্তায় চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র এবং ঢাকা ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম ও গবেষণা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বরাবরে স্মারকলিপি ও জাতীয় সংসদের তথকালীন মাননীয় ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী এমপি’র সাথে তাঁর সরকারি সংসদ সচিবালয়ে সাক্ষাৎপূর্বক বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে সরকারের ভূমিকা ও যুগোপযুক্ত আইন পাশের দাবি জানানো হয়। এর সুফল হিসেবে ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশ হয়- ‘আইনের খসড়া প্রস্তুতি-প্রত্ন সম্পদ ধ্বংসের সাজা ১০ বছরের কারাদন্ড’। এ বিষয়ে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে নীতিগত অনুমোদন পেলেই প্রস্তাবিত প্রত্ন আইনটি বাংলাদেশের ইতিহাস সংরক্ষণে এটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে।
দেশের ৬৪টি জেলার ঐতিহাসিক প্রত্নসম্পদ সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হলেও চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার- এই পাঁচটি জেলায় মাত্র ১টি মোঘল আমলের মসজিদ (বকশী হামিদ মসজিদ, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম)-কে প্রত্ন আইনে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানেও প্রত্ন আইন অমান্য করে মসজিদের দরজা ও ফ্লোরে আধুনিক টাইলস লাগানো হয়েছে, কিন্তু সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
চট্টগ্রামের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রতœসম্পদের মধ্যে এখনো সংরক্ষণ হয়নি ব্রিটিশযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত জালালাবাদের বিখ্যাত সেই পাহাড় ও প্রীতিলতার স্মৃতিজড়িত ইউরোপিয়ান ক্লাব, হাবিলদার রজব আলীর স্মৃতিজড়িত কাজেম নগর (প্যারেড ময়দান)। বিশ্ব জাদুঘর দিবসে সমগ্র বিশ্ববাসীর সাথে বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামবাসীও পালন করবে দিবসটি। চট্টগ্রামের সাড়ে চার হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আলোকিত করে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন একটি নগর জাদুঘর। এই নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রাম নগরীতে একটি নগর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা গেলে লক্ষ লক্ষ সচেতন জনতার সাথে আমাদেরও প্রত্যাশা পূরণ হবে। আশা করছি এই বিষয়ে দ্রæত পদক্ষেপ নিবেন। একটি নগর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা হলে সহজেই পর্যটকেরা চট্টগ্রামকে দর্শন করতে পারবেন। জানতে পারবেন চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে।
ইতিহাসের প্রয়োজনে, বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজনে সরকার চট্টগ্রাম নগরীতে একটি নগর মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস ধরে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন- বিশ্ব জাদুঘর দিবসে সরকারের প্রতি চট্টগ্রামবাসী এই দাবি জানাচ্ছে।
লেখক : ইতিহাস গবেষক