প্রাচীন ও লোকসাহিত্যের অন্যতম সংগ্রাহক ও গবেষক : ইসহাক চৌধুরী

86

শাকিল আহমদ

সাহিত্যের কোনো একটি শাখার গভীরে প্রবেশ করে কাজ করতে করতে একজন মননশীল লেখক অনেক তথ্য-উপাত্ত উপস্থান ও বিশ্লেষণ করে এক সময় বিশেষজ্ঞ বা গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে থাকেন। তবে সাহিত্যের নানা শাখার মধ্যে প্রাচীন পুঁথি সাহিত্য ও লোকসাহিত্যের ওপর কাজ করা তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কঠিন। কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গোয়াল ঘরের চালা, ঘরের অব্যবহৃত ছাদ, কিম্বা পরিবারের পরিত্যক্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তুপ থেকে পুরুনো পুঁথির পান্ডূলিপি কিম্বা লোকসাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করা আদৌ সহজ কাজ নয়। সেই আদী ও মধ্যযুগের অপ্রচলিত ভাষা থেকে পুঁথির পাঠ উদ্ধার করা এবং সেই পুরুনো তুলট কাগজ কিম্বা উইপোকা-ঘুনপোকায় আক্রান্ত হাতে লেখা অস্পষ্ট পান্ডূলিপি গুলোকে সংরক্ষণ করা রীতিমতো কঠিন কাজ বৈকি। এসব কারণে এই শ্রমলব্ধ কাজে সহজেই কেউ জড়াতে চায়না; একান্তই মনের নেশায় জড়িয়ে না পড়লে। আর শিল্প সাহিত্যের এই কঠিনতম কাজটি দুই প্রজন্ম ধরে হৃদয়ে ধারণ করেছেন লোকসাহিত্য ও প্রাচীন সাহিত্যের সংগ্রাহক ও গবেষক ইসহাক চৌধুরী (১৯৫২ – ২০২০)।
মূলত তাঁর পিতা আবদুস সাত্তারের (১৯১৯ – ১৯৮২) হাত ধরেই তিনি এ পথে হাঁঠতে শুরু করেন। পুঁথি সাহিত্য আবিষ্কারের অন্যতম পথিকৃৎ ও গবেষক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অনুপ্রেরনায় আবদুস সাত্তার চৌধুরী পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজে নেমেছিলেন এবং এ পথে তিনি অনেকটা পথও হেঁটেছেন। পিতার এই অসমাপ্ত কাজটিকে হৃদয়ে-মননে এবং জীবন-জীবিকায় আমৃত্যু লালন-পালন ও সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের এই চট্টগ্রামের প্রিয় মানুষ ইসহাক চৌধুরী। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থগারের ‘পান্ডূলিপি ও দুষ্প্রাপ্য’ বিভাগটিতে দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকার কারণে ইসহাক চৌধুরীর ক্ষেত্রে এই কঠিনতর কাজে অগ্রসর হতে অনুপ্রেরণা, সাহস, শক্তি ও আনন্দ যোগীয়েছে। এতে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থগার বিভাগ ও একজন যথার্ত যোগ্য ব্যক্তির পদায়ন পেয়ে হৃদ্ধ হয়েছে; ফলত ইসহাক চৌধুরীকে অবসরে যাওয়ার পরও এ পদে বহাল রেখেছিল।
ইসহাক চৌধুরী সম্পর্কে কিছু লিখতে বসে আজ আমার চিত্তপটে প্রথমেই ভেসে আসছে তাঁকে প্রথম দেখা এবং দীর্ঘ বিরতির পর অনেকটা নাটকীয় ভাবে পুন:পরিচয় এবং ক্রমাগত সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠার দিনগুলির কথা।
ইসহাক চৌধুরী পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক ধন-সম্পদ পাননি; পেয়েছিলেন বেশ কিছু দু®প্রাপ্য, দূর্লব পুঁথি। একজন সন্তান পিতার কাছ থেকে পাওয়া সম্পদকে যেমন যক্ষের ধন মনে করে; আমাদের ইসহাক চৌধুরীও তেমনি পিতার সহগৃহীত পুঁথিগুলোকে আমৃত্যু যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখে- গবেষণা করে, উল্টে-পাল্টে দেখে, যত্নসহকারে সংরক্ষণ করে জীবনের চরম সুখ ও প্রাপ্তী লাভ করেছিলেন; তাঁর সাথে দীর্ঘদিনের আলাপচারিতায় আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
ইসহাক চৌধুরীকে পিতার যোগ্য উত্তরাধিকারই বলতে হবে। তাঁর পিতা আবদুস সাত্তার চৌধুরী একসময় পুঁথি সংগ্রাহক ও পুঁথি গবেষক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ- এর কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারই পদানুসরন করেন। পরাশুনা সমাপ্তের পর একটি মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বটে, তবে তাঁর মন পরে থাকতো লোকসাহিত্য ও পুঁথি সাহিত্য সংগ্রহের জন্য গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেরানো। ষাটের দশকের প্রথম ভাগে আবদুস সাত্তার চৌধুরী বাংলা একাডেমির লোকসাহিত্য ও পুঁথি সাহিত্য সংগ্রাহক ছিলেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬৭ সালে নবগঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থগারে পুঁথি সংগ্রাহক হিসেবে যোগদেন। ১৯৭২ সালে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির ‘পান্ডূলিপি ও দুষ্প্রপ্য’ শাখা। আবদুস সাত্তার চৌধুরী ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগে কর্মরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর ইসহাক চৌধুরীও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থগারে যোগ দেন। চাকুরির পাশা-পাশি তিনিও আমৃত্যু দুষ্প্রপ্য পুঁথি ও লোকসাহিত্য সংগ্রহে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লেখা ও গবেষণার কাজে নিজেকে ব্যপৃত রাখেন। আবদুস সাত্তার চৌধুরী কিন্তু তাঁর একমাত্র সন্তানকেও নিজের মতো পুঁথি সাহিত্য ও লোকসাহিত্য উদ্ধার, সংগ্রহ ও গবেষণায় কাজ করার জন্য তৈরী করেছিলেন। ফলত তাঁর অসমাপ্ত অনেক কাজই ইসহাক চৌধুরী সম্পন্ন করেছেন। পিতার সংগ্রহশালাকে গড়ে তুলেছেন বিশাল ব্যক্তিগত সংগ্রহ শালায়।
ভাষা বিজ্ঞানী ও লোকসাহিত্য গবেষক আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মনিরুজ্জামান পারিপার্শিক পরিস্থিত অবলোকন করে ইসহাক চৌধুরীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে মৃত্যুর পর পর আজাদী পত্রিকায় নিবন্ধের শিরোনাম করেছেন “ইসহাক চৌধুরীর: চট্টগ্রামের প্রাচীন ও লোকসাহিত্যের শেষ গবেষক”। সতিকার অর্থে তিনি চট্টগ্রামে ইসহাক চৌধুরীর পরবর্তী আর তেমন কাউকে খুঁজে পাননি। মনিরুজ্জামান স্যারের এই ধারণাটি যদি সত্যিতে পরিণত হয়, তা হলে আমাদের প্রাচীন সাহিত্য ভান্ডারের জন্য এটি একটি অসনি সংকেত। কারণ আমাদের পুঁথি সাহিত্য ও লোকসাহিত্যের এখনো অনেক কিছু অনাবিষ্কৃত ও গবেষণার দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে গেছে এবং এই লুপ্ত সাহিত্য সম্পদের অনেক গুলো রয়েছে এই চট্টগ্রামেই। এই চট্টগ্রাম থেকেই অনেক নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার হয়েছে এবং হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। গবেষক চৌধুরী আহমদ ছফার একান্ত আগ্রহ এবং অক্লান্ত শ্রমের ফলে ‘কালান্তর সাহিত্যে ফটিকছড়ির এক বিস্মৃত অধ্যায়’ (২০০১) গ্রন্থে আবিষ্কার হয় জমিদার কবি আসমত আলী রচিত তাঁর ‘চিনফগপুর সাহা’ পুঁথিটির সম্পূর্ণ পান্ডূলিপি। ইতিপূর্বে ড. মুহম্মদ এনামূল হক এই কাব্যের অংশবিশেষ যে পান্ডূলিপি সংগ্রহ করেন, আবদুল করিম সাহিত্র বিশারত তাঁর ‘পুঁথি পরিচিতি’ গ্রন্থে শিরোনামহীন এই পান্ডূলিপির নাম দিয়েছেন ‘করমুচ রাজার কেচ্ছা’। ‘সাম্প্রতিক তথ্য বিচারে গোলেবকাউলী’র কবি মোহাম্মদ মুকিব’ প্রবন্ধে চৌধুরী আহমদ ছফার শেষ দিকের গবেষণায় দুই মুকিব সম্পর্কে বিভ্রান্তির ও অবসান ঘটে। এ সমস্ত কাজের সংশোধনী থেকে প্রতিয়মান হয় যে চট্টগ্রামে আরো কত মধ্যযুগীয় অনুৎঘাটিত সাহিত্য ভান্ডার রয়েছে। ইসহাক চৌধুরীর পর যদি এই শাখায় অন্য কোন গবেষকের আবির্ভাব না ঘটে তাহলে পুঁথি ও লোকসাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে হবে বড় অন্তরায়। কারণ সতের, আঠারো এবং ঊনিশ শতকের অনেক মূল্যবান সাহিত্যই কিন্তু এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে আছে।
চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে ইসহাক চৌধুরীর পান্ডিত্ব্য ছিল অসাধারণ। প্রচার বিমুখ এই মানুষটি যতটা পন্ডিত ছিলেন ততটা সাহিত্যসমাজের মানুষ বুঝে ওঠতে পারেনি। সাহিত্যের হারানো ধারাটিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় চার দশক ধরে নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। লিখেছেন তথ্য সমৃদ্ধ প্রায় দুই শতাধিকের মতো প্রবন্ধ। এসব মূল্যবান প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও সাময়িকীতে বিচ্ছিন্ন ভাবে রয়ে গেছে। এ যাবৎ তাঁর কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি বলে সাধারণ পাঠকের কাছে তার মূল্যবান লেখা গুলো অন্তরালেই রয়ে গেছে। ব্যবসা নির্ভর আধুনিক প্রকাশনা জগতের কেউ হাত বাড়িয়ে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগী হয়নি। আতœসম্মানে ঠাষা মানুষ ইসহাক চৌধুরীও কারো কাছে ধন্যা দেননি। তবে তাঁর কর্মের মূল্যায়ন কোনো না কোনো সময়ে হতে বাধ্য।
ইসহাক চৌধুরী নিজেই এ যাবৎ দুই হাজারের অধিক পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। অনেক পুঁথির জঠিল পাঠোদ্ধারও তিনি করেছেন। বাংলা সাহিত্যের জন্য এসব অমূল্য সম্পদও বটে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পুঁথি সংগ্রহ শালাটি তাঁর হাত ধরে আরো ঋদ্ধ হয়েছে। এই সমৃদ্ধ সংগ্রহ শালাটি এবং তাঁর লেখা অসমাপ্ত প্রবন্ধের পান্ডূলিপি, বই এর পান্ডূলিপি, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধাবলির সঠিক সংরক্ষনই হবে তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন। তাঁর কন্যা জান্নাতুন নাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। পিতা ও পিতামহের সংগ্রহ শালার প্রতি তার আন্তরিকতা রয়েছে এমনটিই আমাদের ধারণা। ইসহাক চৌধুরীর ভাগিনা সুলেখক ইসমাইল জসিমেরও এ বিষয়ে প্রবল আগ্রহের কথা ইসহাক ভাই আমাকে আগেই ধারণা দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর পর ইসমাইল জসিমের সাথে আমার বার কয়েক কথা হয়েছে; এবিষয়ে তাঁরও আন্তরিকতা অফুরান। ইসহাক চৌধুরীর মূল্যবান লেখা গুলোকে বই এর মলাটে আবদ্ধ করার জন্য চট্টগ্রামের প্রকাশকদের ও দায়িত্ব কম নয়। কারণ ইসহাক চৌধুরী চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্যকেই ঋদ্ধ করে গেছেন।