প্রসঙ্গ : রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ

150

ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে সরাসরি স্বাক্ষাতের কথা তেমন একটা উল্লেখ পাওয়া যায়না। তবে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের বিভিন্ন কথাবার্তায় এবং তৎকালিন সময়ের বিভিন্ন বইপত্রে তাদের মধ্যে যে একটি অদৃশ্য সম্পর্ক ছিল তা একেবারে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়।
একই সময়ে জন্মগ্রহণ করা এই দু’জন বিখ্যাত মানুষের মধ্যে বলা হয়ে থাকে কখনও সরাসরি স্বাক্ষাৎ ঘটেনি অথচ উক্ত সময়ে দু’জনই স্ব- স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিলেন এবং উভয়েই ভারতবর্ষকে পৃথিবীরবুকে তুলে ধরেছিলেন অনন্য উচ্চতায়।
এখন প্রশ্ন হলো এ দু’জন জ্ঞানি মানুষ একজন আরেকজনের সাথে কেনইবা যোগাযোগ করলেননা।
সত্যিই কী এদের মধ্যে যোগাযোগ হয়নি ? নাকী এর পেছনে আরো কোনো সত্য লুকিয়ে আছে।
তবে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় বিবেকানন্দের কথা আসায় অনেকে ধারনা করছেন যে বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের কথা বা স্বাক্ষাৎ নাহলেও তিনি যে বিবেকানন্দের মহৎ কৃতিত্বগুলো সম্পর্কে ভালোই খোঁজ খবর রাখতেন তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্র যুগে দেশ বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের সাথেই রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষাৎ হয়েছিল কিন্তু বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের কেনো স্বাক্ষাৎ হলোনা কিংবা হলেও কেনো কোনো কথা হলোনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। খুব সম্ভব বিবেকানন্দের চর্চার বিষয় ধর্ম হওয়ায় বিবেকানন্দ বরীন্দ্রনাথের মতো একজন এতো বড় সাহিত্যিকের সাথে দেখা করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন কিংবা বিবেকানন্দের বয়স রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দু’বছর কম হওয়ায় তিনি হয়ত তার চেয়ে বয়সে বড় ববীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে উৎসাহি ছিলেন না। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো দ্বিপেন্দ্রনাথের সাথে বিবেকানন্দের বন্ধুত্ব থাকায় ছোট হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অত্যধিক সম্মানের কারণে রবীন্দ্রনাথের সামনা সামনি কখনও আসতে চাননি।
বয়সের ফারাক মাত্র দু’বছর। একে অপরের জন্মভিটেও মাত্র মাইল দেড়েক দূরে। তা সত্ত্বেও কি দু’জনের পরিচয় ছিল না? অবশ্য পরিচয় ছিল না বললেও কি খুব ঠিক বলা হয়? মুখোমুখি হওয়ার অকাট্য প্রমাণ ইতিহাস আমাদের জন্য না রাখলেও তারা যে একে অপরের গুণগ্রাহী ছিলেন সে বিষয়ে তো সন্দেহ থাকে না।
দু’বছরের ব্যবধানে দু’জনের জন্ম । একজনের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, অন্যজনের জন্ম কলকাতার কাছেই সিমলা স্ট্রিটে, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। দু’জনে কি দু’জনার কাছে আসতে পেরেছেন কখনও? অবশ্য এ নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আগে, পরে এবং সমকালীন বিভিন্ন মনীষী, বৈজ্ঞানিক ও মহান মানুষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো বলে জানা যায়। অথচ বিবেকানন্দের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়নি বা প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটেনি এমনটা ভাবা বড় অদ্ভুত ঠেকে।
রবীন্দ্রনাথের ভাইপো দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ছিলেন তিনি অবশ্য বিবেকানন্দের শৈশব বন্ধু। তখন তিনি নরেন, স্বামী বিবেকানন্দ হননি। দ্বিজেন্দ্রনাথের আসরে নরেন আসেন নানা বিষয়ে আলোচনা ও গল্প করতে। নিত্য যাতায়াতের ফলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে নরেনের পরিচয় হয়। দেবেন্দ্রনাথ প্রথম দর্শনেই পুত্রতুল্য এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হন। নরেনও এই মহর্ষির আচরণ ও নীতিনিষ্টায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমনকি, বিবেকানন্দের “সংগীত কল্পতরু”তে রবি ঠাকুরের ১২টি গানও সংকলিত হয়েছে, যেগুলি নরেন ঠাকুর রামকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে গেয়ে শোনাতেন।
বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই শোনান- ‘তোমারই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’, ‘মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত’ প্রভৃতি। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, তা কুয়াশাচ্ছন্ন রয়ে যায়।
দেবেন্দ্রনাথের কাছে নরেন্দ্রনাথের বার বার আসা যাওয়া সেই সময়ে তাঁর মনের যে গভীর আধ্যাত্মিক সংকটের উপস্থিত হয়েছিল সে কথা জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করেছেন। একদিন “প্রাণের উৎকণ্ঠা নিয়ে স্বামীজী মহর্ষি কাছে উপস্থিত হলেন”। তিনি যে ব্রাহ্ম সমাজে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেকথা জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করে বলেছেন, ‘নরেন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করিতে করিতে ক্রমে রীতিমতো খাতায় নাম লিখইয়ে ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত হইলেন। এমনকি যখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে বিশ্ববিখ্যাত হইয়াছেন তখনো হয়তো ব্রাহ্মদিগের খাতায় নাম ছিল’ (স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমভাগ- প্রমথনাথ বসু)। যাই হোক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাৎকারের সেরকম কোনও তথ্যভিত্তিক ঘটনার উল্লেখ না পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে নিবেদিতার ভূমিকাটি অস্বীকার করা যায় না। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ ৩০শে জানুয়ারি (১৮ মাঘ) মঙ্গলবার জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লেখা নিবেদিতার একটি পত্রে জানা যায় নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মাঘোৎসবে বা অন্য কোনও সংগীত সভায় রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ দু’টি গানও গেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কথাবার্তা হয়নি। নিবেদিতাও লিখেছিলেন, ‘only there was some cloud- I could not tell what’. মেঘই থেকে গেল, আকাশ পরিষ্কার হল না। কিন্তু রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহসভায় ‘ব্রাহ্ম সুকবি’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছিলেন তার একটি হল- “দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি বল দেব! কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়’’।
বলা বাহুল্য দু’টি হৃদয়ের নদী কোথাও মিলিত হল না। নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ হওয়ার পর শাক্ত ধর্মের উপাসক হয়ে উঠলেন, অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের হয়েও সর্বোপরি মানবধর্মের কবি। আবার আমেরিকার শিকাগো ভাষণে বিবেকানন্দের মতো মানবধর্মের উপর বড় ভাষণ খুব কমই শোনা যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্র সৃষ্টির মধ্যে বিবেকানন্দের প্রতিফলন তাঁর জীবিত ও মৃত্যুর পরও বহু জায়গায় লক্ষ্য করা যায়। এমনকি, বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর শোকসভাতেও রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রায় নীরব ও উদাসীন থেকেই গিয়েছেন। এ ছাড়া এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ, জাপানের বিখ্যাত কবি ওকাকুরা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গটি খুব গুরুত্বপুর্ণ। ভারতবর্ষকে বুঝতে ওকাকুরা বিবেকানন্দের কাছে গেলে তিনি বলেছিলেন- “এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে যান। তিনি তখনো জীবনের মধ্যে আছেন”। ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে গিয়েছিলেন। এই কথা বিবেকানন্দের রবীন্দ্রপ্রতিভা ও সৃষ্টি কর্মকে সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপর দিকে ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন- “ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negativeÓ. (Chintanayak Vivekananda pg.981)।
পরবর্তী কালের ইতিহাস কিন্তু অন্যরকম দু’জনের জীবন মোড় নিল দু’দিকে। একজন সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টির সূতোয় মালা গাঁথলেন, নোবেল পেলেন, এশিয়া মহাদেশে ভারতকে সবাই চিনল আর অন্যজন ভারতকে বিশ্বের দরবারে বিভিন্ন দিক থেকে মহান করে তুললেন বিশেষ করে ধ্যানে, ত্যাগে, সেবায়। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে সামনাসামনি স্বাক্ষাৎ নিয়ে
বিভিন্ন মতবাদ থাকলেও উক্ত দু’জন জ্ঞানি মানুষ
একে অপরের খবর রাখতেন এবং একে অপরের লিখিত গ্রন্থ সমূহ পড়তেন তা তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ ও তাদের
লিখনি থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
এ দু’জনের সম্পর্ক বিষয়ে ভারতবর্ষর বেশকিছু বিদগ্ধ লেখক এবং গবেষক এখনও গবেষণা করে
চলেছেন। অদূর ভবিষতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আধ্যাত্মিক এবং জ্ঞানি সিদ্ধপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আদৌ কেমন সম্পর্ক ছিল তা হয়তো আমরা জানতে পারবো। তবে বর্তমানে
প্রাপ্ত সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা স্পষ্ট বলতে পারি যে বিবেকানন্দেরর সাথে রবীন্দ্রনাথের
তেমন একটা সম্পর্ক ছিলনা তবে তারা দু’জন দু’জনের লেখা পড়তেন এবং রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ খবর রাখতেন।
তবে খুব সম্ভাবতঃ বরীন্দ্রনাথের ভাইপোর সাথে বিবেকানন্দের বন্ধুত্ব থাকায় বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের খোঁজ খবর সবসময় পেতেন বলেই হয়ত বরীন্দ্রনাথের সাথে স্বাক্ষাতের প্রয়োজন হয় নাই।
যাই হোক রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল কিংবা সরাসরি স্বাক্ষাৎ হয়েছিল কীনা তা হয়তো অদূর ভবিষতে আমরা জানতে পারবো তবে এই দু’জন বিখ্যাত মানুষ তাদের নিজ নিজ কর্মকান্ডের জন্য পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে ভারতবর্ষকে যে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।