প্রসঙ্গ-মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা

31

বাসুদেব খাস্তগীর

সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে সবসময় একটি আলোচিত বিষয়। পত্রিকার পাতা উল্টালেই প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমাদের নজরে আসে। আর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও আমরা প্রায়সময় সড়ক দুর্ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন দেখি। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের কারো কাছে কাম্য নয়। তবুও প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা যে ঘটবে না তা কখনও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে দুর্ঘটনার কারণ এবং তার ঘটে যাওয়ার মাত্রা নিয়ে নানা প্রশ্ন জনমনে উঁকি দেয়। এই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত হচ্ছে এবং দেশের সুধীজনরা এ নিয়ে প্রতিনিয়ত লেখালেখিও করছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের আহাজারি আমাদের বেদনাপ্লুত করে তোলে। কিন্তু সেই দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরে তার পরিবারের সেই করুণ আর্তির খবর আমরা কজনই বা রাখি? রাখতে পারি না, রাখা যায় না। বড় বড় অনেক দুর্ঘটনা আমাদের মনে হয়তো অনেকদিন রেশ হিসাবে থেকে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সে কথাই স্যু-একটি দুর্ঘটনা মানে সারা জীবনের কান্না। এই দুর্ঘটনার একটি দিক এখানে আলোচনায় নিতে চাই সেটা হচ্ছে অতিসা¤প্রতিক সময়ের আলোচিত মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে। বর্তমানে উদ্বেগজনক হারে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে এবং দুর্ঘটনার সে হার আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা যে চিত্র আমাদের চোখে পড়ছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিদিন যে হারে তরুণেরা মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে তা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভাবিয়ে তুলছে। একসময় স্কুল কলেজের ছাত্রদের কাছে বাই সাইকেল ছিলো একটি প্রিয়বাহন। এখন সেই জায়গায় মোটর সাইকেল অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। আর গ্রামে বা শহরে উঠতি বয়সের তরুণদের নিকট মোটর সাইকেল একটি প্রিয় বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোটর সাইকেলের গুরুত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পৃথিবীর সকল দেশেই মোটর সাইকেল একটি প্রিয় বাহন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দেশের মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার হারটা কেমন? পরিসংখ্যান বলছে নিশ্চয়ই অনেক অনেক গুণ বেশি। এদেশের অনেক অভিভাবক তার ছেলের আবদার বা দাবি রক্ষা করতে গিয়ে মোটর সাইকেল কিনে দেন। তাদের শিক্ষা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, রাস্তাঘাটের নিয়ম কানুন, ট্রাফিক ইণ্যাদির কতটুকুই বা সে জ্ঞান রাখে তার তোয়াক্কা কেউ করেন না। তার বয়স পরিক্কতার বিষয়গুলোও এখানে বিবেচনার দাবি রাখে। তরুণরা স্বাভবিকভাবে একটু কৌত‚হলপ্রবণ হয়। মোটর সাইকেল পেয়ে তারা একধরনের আবেগে জড়িত হয়ে যায়, তাদের মধ্যে বীরত্ব প্রদর্শনেরর প্রবণতা সৃষ্টি হয়। ফলে অকালে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির একটি তথ্য মতে, দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশেরই বয়স ২১ এর নিচে অর্থাৎ কিশোর-তরুণ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য মোটর সাইকেল অপরিহার্য একটি বাহন দীর্ঘকাল থেকে। তার সাথে বতর্মানে যোগ হয়েছে রাইড শেয়ারিং ব্যবসায়। ফলে যানজটের শহরে ও অন্যান্য জায়গায় দ্রæত গতিতে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য মোটর সাইকেল হয়েছে এখন অপরিহার্য একটি বাহন। কিন্তু সে বাহনটি অনেক অপরিণত ছেলেপেলের কাছে যাচ্ছে অভিভাবকদের অসচেতনুার কারণে। তবে অভিজ্ঞ অনেকেও এ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখলে এবং এ ব্যাপারে জনসচেতনুা সৃষ্টি হলে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা অনেক কমে যেতে পারে। প্রয়োজনে মোটর সাইকেল চড়তেই হয়। জরুরি প্রয়োজনে মোটর সাইকেলের তুলনা হয় না। দুর্ঘটনা হতেই পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে তার সতর্কতা ও সচেতনুার সহিত চালানোর বিষয়টি। আর মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তি সচেতনুাই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। আমাদের দেশে উঠতি তরুণ বয়সী ছেলেদের এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এদের কেউ কেউ এমন বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল চালান যেন একটি বীরত্ব প্রদর্শনের একটি জায়গা। মোটরসাইকেল চালানোর সময় র্সুক থাকার পাশাপাশি প্রশাসনেররও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ট্রাফিক আইন যথাযথ প্রয়োগ, সব মোটরসাইকেল যেন নিবন্ধনের আওতায় থাকে, লাইসেন্সবিহীন চালকদের আইনের আওতায় আনা, ১৮ বছরের নিচে কেউ যাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স না পায় এই বিষয়গুলোতে নজরদারি থাকা প্রয়োজন। পারিবারিক সচেতনুা ও প্রশাসনিক দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে মোটরসাইকেলের মত দু’চাকা যানের দুর্ঘটনা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। গণ ৪ অক্টোবর ২০২২ -এ একাত্তর টেলিভিশনে মোটর সাইকেল নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয় শুধু গণ সেপ্টেম্বর মাসেই দেশে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৯ জন। সেভ দ্য রোড এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে গণ অক্টোবর মাসে গড়ে প্রতিদিন ১১৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২১ জন, নিহত হয়েছেন ১৬ জন। এছাড়া ৭৬৩টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫৯১ জন এবং নিহত হয়েছেন ৬০ জন। নভেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৬৩ টি। দুর্ঘটনায় নিহত ৫৫৪ জন এবং আহত ৭৪৭ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে ১৯৪ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২২৯ জন, যা মোট নিহতের ৪১.৩৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১.৯০ শতাংশ। ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে গণ নভেম্বর মাসের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। দেশে বিগণ ৩ মাসের দুর্ঘটনার মধ্যে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার এই হচ্ছে চিত্র। গণ ৪ অক্টোবর একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত ঐ প্রতিবেদনে বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কাজী সুফিয়ান নেওয়াজ এ প্রসঙ্গে যা বলেন তার সারাংশ হচ্ছে, মোটর সাইকেল জনপ্রিয় বাহন বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে। সেই তরুণ সমাজের একটি অংশ মোটর সাইকেল ব্যবহারে অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করে দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। জাতিসংঘের একটি সংস্থার জরীপের উদ্ধৃতি তিনি বলেন, পথচারী, বাই-সাইকেল ও মোটর সাইকেল নিয়ে গবেষণা করে সংস্থাটি দেখিয়েছে এই তিনটির মধ্যে মোটর সাইকেল একটি ঝুঁকিপুর্ণ বাহন। কারণ এটি দুঘর্টনায় পড়লে হতাহতের পরিমাণ বেশি হয়। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট পরিবহনের প্রায় ৬৩ শতাংশই হচ্ছে মোটর সাইকেল। দক্ষিণ এশিয়ার আর ১০টি দেশের দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে এক লক্ষ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশে সে তুলনায় মোটর সাইকেল অনেক কম। কিন্তু প্রতি দশহাজারে বাংলাদেশে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা সবচাইতে বেশি। কারণ হিসাবে তিনি বলেন মোটর সাইকেল একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাহন, এটি চালানোর জন্য বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন ও বিশেষ সচেতনুার প্রয়োজন। এদেশে মোটর সাইকেল চালকদের মধ্যে এগুলোর বড়ই অভাব। এদেশের রাস্তাগুলোতে রিক্সা বাসসহ নানা ধরনের যানবাহন চলে। রিক্সা বা অন্যান্য যানগুলো হঠাৎ যখন রাস্তায় থামে বা নিয়ম মানে না, তখন দু’চাকার যান হিসাবে মোটর সাইকেলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। অন্যান্য দেশে যেভাবে লাইন মেনে নিয়ম মেনে মহাসড়কে গাড়ি চলে এদেশে রাস্তার পাশে পার্কিং, রাস্তার আশপাশ ভাঙাচোরা, দোকানপাট তৈরিসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় সড়ক পথ ততটা নিরাপদ পরিবেশ সম্পন্ন নয়। তার ওপরে রাইড শেয়ারিং ব্যবসা জেঁকে বসেছে, যাদের অনেকেই গ্রাম থেকে শহরে আসা। যারা শহরে এ যানবাহনের ভিতরে গাড়ি চালানোয় অভ্যস্ত নয়। তারা লুকিং গøাসে ডান বামে সবসময় নজর রাখবে সে সচেতনুায় অভ্যস্ত না। আর এদেশের অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের হেলমেট নির্দিষ্ট মানের নয়, পেছনে বসা ব্যক্তির মধ্যে অনেকের হেলমেট থাকে না, আবার বাচ্চাদের মাঝখানে নিয়ে অনেকেই মোটর সাইকেল চালান, তাদের কারো হেলমেট থাকে না। আর মহাসড়কে মোটর সাইকেল চালানোর কোন নিয়মই নাই। কত সিসির গাড়ি উঠতে পারবে কত গতিতে চলতে পারবে তার নিয়মকানুন নেই। কারণ মহাসড়কে ওভার স্পিডিং করার সুযোগ থাকে। ফলে নানা অনিয়ম ও অসচেতনুায় অন্যান্য দেশের তুলনায় এদেশে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি, আর অন্যান্য দেশে অনেক কম কিন্তু সে সব দেশে মোটর সাইকেলের ব্যবহার আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর এ বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সড়ক পথে নিয়ম না মানাসহ মোটর সাইকেল ব্যবহারে নানা নীতিমালা সম্পর্কিত এক এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. কাজী সুফিয়ান নেওয়াজ বলেন, ‘এদেশের মোট যানবাহনের ৬৩% যেখানে মোটর সাইকেল সেখানে সহজেই অনুমেয় এদেশে যে কেউ চাইলে এটা কিনতে পারে। এ দেশে মোটর সাইকেল ব্যবসায়ীদের নানা প্রলুব্ধকরণ অফার, তিন মাস বা ছয়মাসের কিস্তিতে নেবার সুযোগসহ নানা অফারে ফাঁদে পা দিচ্ছি আমরা। সরকার এখানে কোনো পলিসি গ্রহণ করছে না। কত মোটর সাইকেল বিক্রি করবে, কোথায় কত তার লিমিট কত হবে এবং তা যদি আমরা করতে না পারি তাহলে আমরা ভবিষ্যতে ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের মত হয়ে যাব। তারা কিন্তু মোটর সাইকেল নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছে। এক সময় শহরে নসিমন করিমন বেড়ে যায়, কিন্তু ব্যাপারটা আমরা কেউ খেয়াল করিনি। আমরা মনে করেছি মানুষ এটা ব্যবহার করবে। একসময় মহাসড়কে এটি গলার কাঁটা হয়ে যায়। মোটর সাইকেলও কিন্তু এখন ঠিক সেরূপ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মোটর সাইকেল কিনবে সমস্যা নাই, কিন্তু তার একটি সীমাবদ্ধতা তৈরি করে দিতে হবে। কারা কারা কিনতে পারবে, তাদের লাইসেন্স থাকতে হবে, বয়স কত হবে, কতগাড়ি বিক্রি করবে, কত সিসির বিক্রি হবে ইণ্যাদি বিষয়ে পলিসি গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে দেশে সড়ক পথ অনুপাতে শহরে নগরে মোটর সাইকেলের সংখ্যা বেড়ে যাবে। মানুষ মোটর সাইকেল কিনে কেন? কারণ সে বাসে যেতে পারে না বা বাসে উঠতে পারে না। আবার বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেয়া বা দ্রæত কোথাও পৌঁছার জন্য মোটর সাইকেল কেনে। এই বিষয়টি নজরে নিয়ে মানুষ যাতে পাবলিক যানবাহনে চড়তে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।’ তাঁর এই ভাবনাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং সামগ্রিক মতামতগুলো অবশ্যই সুচিন্তিত বিবেচনার দাবি রাখে। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট মহলের নজরদারি খুবই প্রয়োজন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক