প্রসঙ্গ : মাতৃভাষার চর্চা ও তার ব্যবহার

13

এমরান চৌধুরী

আমাদের যাপিত জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের দাবিটি অনেক পুরানো। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অর্থাৎ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিউর আর সর্বকনিষ্ঠ শহিদ অহিউল্লাহ’র আত্মদানের সত্তর বছর পরও সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের লক্ষমাত্রা এখনো শতভাগ অর্জিত হয়নি এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এর জন্য আমাদের আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। হয়তো আরও ৫০ বছর হয়তো তারচেয়েও বেশি। শত বছর পরেও যদি আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ অর্জনে সমর্থ হই তাই হবে বাঙালি হিসেবে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।
সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি সংস্থা জড়িত। একেক সংস্থা একেক আইন ও বিধিমালার অধীনে পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে, সিদ্ধান্ত দিতে, তার প্রয়োগ আর বাস্তবায়নে সময় নেওয়া স্বাভাবিক ধরে নিলেও শুদ্ধ বানান চর্চা আর শুদ্ধ বানান ব্যবহারে আমাদের মারাত্মক অবহেলার বিষয়টি বড় বেশি পীড়াদায়ক।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রæয়ারিকে সামনে রেখে শহরে-নগরে-গঞ্জে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি সাইনবোর্ড মোছার ধুম পড়ে যায়। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায় সাইনবোর্ড মোছার নামে বিতিকিচ্ছিরি রং দিয়ে সাইনবোর্ডের যা সৌন্দর্য ছিল তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়া হয়। সারাদিন দেদারসে ঘুম গিয়ে হঠাৎ মশার কামড় খেয়ে জেগে উঠে যেমন মশা তাড়ানো কিংবা সমূলে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তেমনি ফেব্রæয়ারি মাস এলে লোকদেখানো কাজ কখনো সুন্দর হওয়ার কথা নয় বা হতে পারে না। এজন্যে প্রয়োজন সদিচ্ছা। সদিচ্ছা ছাড়া কখনো কোনো কাজ সুফল বয়ে আনে না। যে কোনো ভালো কাজের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা এবং তা হতে হবে ধীরে সুস্থে বুঝে শুনে। কি কি করণীয় তা আগে থেকে অবশ্যই পরিকল্পনা করতে হবে। সেই পরিকল্পনা মাফিক যদি কাজে অগ্রসর হওয়া যায় তবেই সাফল্যের কথা চিন্তা করা যায়। সরকারি হুকুমতামিল কিংবা জরিমানার ভয়ে যে কাজ করা হয় তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে না। সব কাজে প্রথম প্রয়োজন কাজটিকে নিজের মনে করা। তারপর আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা। এভাবেই একটি কাজ সুচারুভাবে সুসম্পন্ন হতে পারে। চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত যেমন বাস্তবায়ন হয় না, আর বাস্তবায়িত হলেও যেনতেন প্রকারের হয়ে থাকে তেমনি অন্তর থেকে উৎসারিত না হলে সে কাজে প্রাণ থাকে না।
আমরা যদি নিজেদের নামটি, নিজের প্রতিষ্ঠানের নামটি শুদ্ধ বানানে না লিখি তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা, আমাদের উত্তরাধিকার বহন করবে ভুলের উত্তরাধিকার। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের ভাষা , আমাদের আচরণ, এমনকি আমরা কীভাবে কথা বলি তার সবটাই আমাদের শিশুরা —আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করে। আমরা যা ওদের শেখাই তাই ওরা শেখে। তাই আমাদের আচরণ, আমাদের বানানরীতি এমনই হওয়া উচিত যা তাদের কোমল মনে কোনো ধরনের প্রশ্নের জন্ম না দেয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের শিশুদের প্রথম পাঠ শুরু হয় গৃহকোণ থেকে। আমরা যদি আমাদের শিশুদের বাবার বদলে ড্যাডি শিখাই, চাচা চাচীর বদলে আংকেল,আন্টি শেখাই সারা জীবন তারা সে নামেই পরিচিত হবে মা এর মতো পৃথিবীর সুমিষ্ট ডাক ভুলে তারা মাকে ডাকবে মাম্মি বলে। এ ধরনের মানসিকতা একুশের চেতনা বিকাশে সম্পূর্ণরূপে অন্তরায়। বায়ান্নের শহিদরা প্রাণ দিয়েছিল মাকে মা, বাবাকে বাবা ডাকার জন্য কোনো বিকৃত বা আধা বাংলা আধা ইংরেজি শেখার জন্য নয়।
পথ চলতে আপনি যদি ডানে বামে থাকান দেখবেন ভুলে ভরা অজ¯্র শব্দ। মনে হবে আমরা ‘যেমন খুশি তেমন সাজি’র মতো শব্দের বানান লেখা শুরু করেছি। দোকানের সাইনবোর্ডে, রিক্সার পেছেন, বাসের ভেতরে, অটো রিক্সা বা টেম্পুতে যা লেখা থাকে তা রীতিমত বাংলা ভাষাকে অপমান করার সামিল। এসব দেখে আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে, বড় হচ্ছে। এরা যদি প্রশ্ন করে বাবা লাকড়ি বানান কি? আপনি হয়তো সঠিকটাই বলবেন কিন্তু দোকানে তা আছে ‘লাগড়ি’ নামে।
সাধারণ জনগণকে কী দোষ দিব? এক্ষেত্রে সরকারি কাগজপত্রেও যথেষ্ট ভুল চোখে পড়ার মতো। ২০২২ সালে প্রকাশিত সরকারী ছুটির ক্যালেন্ডারে শহিদ বানান লেখা হয়েছে শহীদ। অথচ বাংলা একাডেমি বানান রীতি অনুসারে তা হবে শহিদ। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল দপ্তর যদি বাংলা সঠিক বানানের প্রতি সতর্ক ও যতœশীল না হয় তাহলে রাস্তাঘাটের সাইনবোর্ড আর রিক্সার পেছনে বিভিন্ন লেখার বানান যারা ভুল করছেন তাদের দায়ি বা দোষারোপ করার কোনো নৈতিক অধিকার আমাদের থাকে না। মায়ের ভাষা মাতৃভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় আসীন। এ ভাষা আমাদের টুকটুকে লাল রক্তজবার বিনিময়ে অর্জিত। বায়ান্নের শহিদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন তখনই হবে যখন দেশের মানুষ বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে সর্বোত্তম মেধা ও সৃজনশীলতার অনুশীলন করবে।
আসুন আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শুদ্ধ বানান চর্চা ও ব্যবহারে সতর্ক ও সচেতন হই এবং প্রাণখুলে গাই
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা
তোমার চরণ- তীর্থে আজি জগৎ করে যাওয়া আসা।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক