প্রসঙ্গ নারী দিবস নয় বৈষম্য! চাই নিরপেক্ষ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি

20

ফারহানা ইসলাম রুহী

পৃথিবী এগিয়ে গেছে বহুদূর।স্বাস্থ্য খাত, শিল্প কারখানা, কুঠির শিল্প, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পে নারী অবস্থান উল্লেখ্যযোগ্য হলেও নারী দিবসের ইতিহাস রচিত করেছেন নারী শ্রমিকেরা আজও তারা বঞ্চিত। মজুরি, কর্মপরিবেশ, সর্বক্ষেত্রে আশানুরূপ সুরক্ষিত নয়।অবমূল্যায়ন খাটো করে দেখার নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি বদলায়নি। ২০২৩ এসেও পক্ষপাতদুষ্ট। তাই ২০২৩ সালের থিম হল- ‘উরমরঃঅখখ: ওহহড়াধঃরড়হ ধহফ ঃবপযহড়ষড়মু ভড়ৎ মবহফবৎ বয়ঁধষরঃু’।
নারী পুরুষের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বৈষম্য দূর হোক। শৈশব থেকে ছেলে সন্তান ও কন্যা সন্তান সমান অধিকার নিয়ে বেড়ে উঠবে। সমাজের সর্বস্তরে এই চিন্তাধারা সুনিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠিত হোক।নারীর কাজের স্বীকৃতি, কর্মসংস্থান, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ মেধা বিকাশের সুযোগ রক্ষায় বাল্যবিবাহ নিরোধ আবশ্যক। নারী চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম। নারী ও পুরুষ দুটি হাত দুটো পায়ের মতন। নারীর সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদাসহ নারীর উন্নয়ন বাদ দিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আর্থ সামাজিক বিশ্ব শান্তি অসম্ভব। নির্যাতনরোধ কল্পে যথাযথ সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা বিধায় অপরাধ বন্ধ হচ্ছেনা। নির্যাতন বেড়েই চলছে।
সমতার যুগ আখ্যা দিলেও আজও ঘরে বাইরে নারীর অবমাননা। কন্যা শিশুর প্রতি অনাদর অবহেলা। বিবাহিত নারী আপন গৃহে শারীরিক মানসিক নির্যাতনের শিকার। এছাড়াও যৌন হয়রানি, ইভটিজিংও নানাবৈষম্যের শিকার। কোথাও নিরাপদ নয় তারা। নারীকে পণ্য রূপে ব্যবহার ও পণ্যের মোড়কে শরীর প্রদর্শনী বন্ধ হোক। সমাজ শিক্ষিত হলেও নারীর প্রতি সহিংসতা আত্মমর্যাদায় আঘাত কমেনি। কোণঠাসা করার নোংরা নীতি কবলে হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে অবদমিত করার প্রচেষ্টায় পাশবিক বর্বরতা, হত্যা অ্যাসিড দগ্ধ করা কিংবা আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কত নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরাঙ্গনাদের যুদ্ধ সমাজ মেনে নিতে চায়নি। অনেকেই বহুবছর পর জনসমক্ষে মুখ খুলেছেন। ধর্ষিতা নারীর বিয়ে সহজেই হতে দেখা যায়না। বরং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে আজীবন।
কটুক্তি যেন শুধু নারীর জন্যেÑ রং কালো হলে, সন্তান ধারনে অক্ষম হলে, ছেলে সন্তান জন্ম না দিলে, যৌতুক চেয়ে, বাবার বাড়ি আর্থিক অবস্থা ভাল না হলে, পিতা কিংবা বড় ভাই দায়িত্ববান নির্ভরযোগ্য অভিভাবক না থাকলে শ্বশুর বাড়িতে অবজ্ঞা অনাদর অবহেলা অবমাননা আর্তমর্যাদায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। অসহায় অবলা ভেবে অত্যাচারের ফলে একাকিত্ব, বিষন্নতা, হতাশা, আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।
এত আন্দোলন সেমিনার সামাজিক অবক্ষয়কে ঠেকাতে পারেনি, সঠিক সময়ে আইন প্রয়োগ হয়নি কালক্ষেপণ ইত্যাদি কারণে অপরাধী সরে পড়ছে নানা রকমের ফাঁকফোকরের মধ্য দিয়ে। আর্থ সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবেই। প্রতিটি নারী এক অসাধারণ মানুষ । এক নিরলস শ্রমজীবী। সন্তান ও গৃহস্থালীর যত সমস্যা একহাতে সামলান। অসুস্থতার হার মানে সংসারের কঠিন দায়িত্বের মাঝে।যার সংসারে আর্থিক মজুরি নেই।নারী ছাড়া পরিবার অচল অসম্পূর্ণ।
দশ ভূজা হয়ে সংসার সামলিয়ে পরিবারকে সন্তুষ্ট করে মন যুগিয়ে বাইরের কাজে সমান দক্ষতা অর্জন করেছে। তাই কর্মজীবী নারী একজন সংগ্রামী মানুষ। যার কোথাও ছাড় ও বিশ্রাম নেই। বাইরে কাজ করার জন্য তাকে গৃহের সমস্ত কিছু গুছিয়ে পিছুটান মাথায় নিয়ে কাজে যেতে হয়। এতকিছুর পর প্রশংসা আপনার নাও জুটতে পারে। হয়ত গৃহকর্মী অনেকদিন আসেনি। চাকরিতে যেতে হবে ঘরের সবার প্রয়োজনটাও ঠিক থাকা চাই। পান থেকে চুন খসলে শুনতে হবে কাল ই চাকরি টা ছেড়ে দাও। সারাদিন তো বাইরেই থাকো ।
সহমর্মী সমব্যথী স্বামী বেশির ভাগ নারীর ভাগ্যে জুটে না। ঘরে বাইরে সামাল দিতে স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা উৎকণ্ঠা ভুগেন বেশি। নীরবে নিভৃতে দুঃখ কষ্ট চেপে কর্ম ও ব্যক্তিজীবন পার করেন।
নারীর রয়েছে অদম্য প্রাণশক্তি। আছে তার কঠিন ইচ্ছাশক্তি। যিনি ভেঙ্গে গিয়েও নতুন ভাবে নিজেকে গড়তে জানেন। নিজের ভালোলাগা আর শখকে বাঁচিয়ে রাখতে পুরুষের চেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়। বাধা বিপত্তির বেড়ারজাল শিকলের মত জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। দিতে হয় ধৈর্য্যরে চরম পরীক্ষা। তবুও লড়াকু সৈনিক হয়ে বিজয়ীর হাসি হাসতে জানেন। বিশ্ব নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের স্মারক দিবস। ১৯১৪ সাল থেকে ৮ই মার্চ নারী দিবস পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালকে জাতিসংঘ নারী বর্ষ হিসাবে ঘোষণা দেন। নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত। সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রযাত্রা অন্তরায়। জেন্ডার বৈষম্য অনুধাবন ও অধিকার সচেতন হওয়া।
সিডিসি গবেষনায় দেখা যায়, জাতিসংঘ যদি গৃহস্থালি শ্রমকে অর্থে হিসাবের বিবেচনায় আনা হতো যেকোনো দেশের জাতীয় আয়ের ৩৯শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হতো। দেশপ্রেম ও বীরত্বে নারী অনন্য। ঝাঁসের রানী ল²ী বাই, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ,তারামন বিবির মত যুগে যুগে সারা বিশ্বে নারীরা নির্ভীক চিত্তের স্বাক্ষর রেখেছে। নারী সেবায় অতুলনীয়, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার তেরেসা মহীয়সী নারীরা জীবের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছে। হেলেন কেলার এক জীবন আদর্শ । এই উদ্যমী নারী প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে নতুন আশার আলো জাগিয়ে যাবে চিরকাল। নারী মৃত্যুকে পরোয়া করেনা। নারী দুর্বার! দুঃসাহসী। ১৩ বছর বয়সী অ্যালিসা কারসন নভোচারী প্রশিক্ষণ শুরু করেছে ২০৩৩-৩৪ সাল নাগাদ মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার জন্য। শতাব্দীর ইতিহাসে এটি হতে যাবে নজির বিহীন ঘটনা। নারী অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে অবিচল অটল।
আত্মবিশ্বাসী, অধ্যাবসায়ী উচ্চাকাক্সক্ষী স্বাধীনচেতা লক্ষ্যের প্রতি অনড়। পর্বত আরোহণ, রাজ্য ও দেশ শাসন, রাজনীতিতে দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। নারীর উন্নয়ন হতে পারে বিশাল মানব সম্পদ। নারীকে অপমান গøানিতের জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হতে হলেও নিজ গুণে সফলতার মুকুট পরেন। নারীর ভূমিকা ছিল ফরাসি বিপ্লব, সাওতাল বিদ্রোহে । নারীর সন্তান লালনে ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে ঝুঁকি নেয়া, আত্মত্যাগ অনস্বীকার্য।
সাহস মনোবল, সাধনা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। আমাজনের যোদ্ধা নারী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। নারীর বহুমুখী প্রতিভার বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে সর্বক্ষেত্রে। খেলার মাঠ অলিম্পিক গেমস হতে শুরু করে ফ্যাশন ডিজাইনে। করোনা দুর্যোগে নারীর ভূমিকা তুলনাহীন। কোনো ভয় তাকে আটকে রাখতে পারেনি। ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো।’ সেই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কথায় ফিরি-
আগামীর নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষিত দক্ষ জনগোষ্ঠীতে রুপান্তর করতে নারী শিক্ষাকে ত্বরান্বিত করতে হবে। যেকোনো দুর্যোগে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সর্বকালে পুরুষের প্রেরণা শক্তি ও সহযোদ্ধা হয়ে অসাধারণ কাজ করে গেছে। ১৯৩৫ সালে জোলিও-ক্যুরি দম্পতি রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
‘কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় ল²ী নারী’
মনে পড়ে জাহানারা ইমামের কথা। ছেলে আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষায় না গিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে যুদ্ধে ফেলে যেতে বিদেশ যেতে অনিচ্ছুক। তাই মাকে প্রশ্ন করেন- ‘বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?’ ছেলের এমন অটল দেশপ্রেম আর ভালোবাসায় মুগ্ধ মা জাহানারা ইমাম রুমিকে আর না করতে পারেননি। তিনি বললেন- ‘না তা চাইনে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।’ নারীর বলিদানের কোনো তুলনা হয়না।
নারী যুগে যুগে কি সয়নি! কত অমানবিক আচরণ! সতীদাহ প্রথা, রাজপুত পরিবারে বিবাহিত নারীদের জহব্রত। নারীর উপর অনাচার সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেই কথা আবারও উত্থাপিত হয়। নানা অপবাদ দিয়ে নির্বাসন ও এক ঘরে করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যতই উচ্চাসনে থাকুক না কেন তাকে কাঠের পুতুল ভাবতে চায় সমাজ। নিশ্চুপ নিষ্ক্রিয় ভাবতে চায়। সেকি বৃক্ষ? সর্বংসহা হয়ে প্রতিবাদ করবেনা।মুখ বুজে সব সইবে! নারীর প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট আচরণ অচিরে বন্ধ হোক। সর্বক্ষেত্রে নারীর যথাযথ অধিকার রক্ষা, মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা মূল্যায়নে সামাজিক সচেতনতা প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক সংগঠক