প্রসঙ্গ : করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও স্বাস্থ্যে নানামুখি অনিয়ম

36

মো. আবদুর রহিম

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব প্রতিপত্তি যাই থাক না কেন? যদি শারীরিকভাবে-মানসিকভাবে কোন মানুষ সুস্থ না থাকে তাহলে তার সুখ-শান্তি-স্বস্তি কিছুই থাকে না। বাংলাদেশ সহ বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি সব মানুষের সুখ-শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চল করোনা ভাইরাসজনিত মহামারিতে আক্রান্ত। ১২ জুলাই ২০২০ খ্রি. পর্যন্ত বিশ্বে এ ভাইরাসে প্রায় ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার ৪৫৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সময়ে প্রাণ হারিয়েছে ২,৩৫২ জন। এ যখন পরিস্থিতি- যখন করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা গভীর হচ্ছে তখন বাংলাদেশের এক শ্রেণির অমানুষ স্বাস্থ্যে কেলেংকারির ঘটনা জন্ম দিয়ে দেশ ও বিদেশে চিকিৎসা সেবাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি, সরকারের অর্জন ও সুফলগুলোকে আড়াল করার হীন চেষ্টা চালাছে।
করোনা মহামারি প্রভাবে সারা দেশের মানুষের উপর মানসিক চাপ ফেলেছে -এই চাপে বহু মানুষ বিপর্যস্ত। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে পারিবারিক ভাবেই নয় প্রতিটি শ্রেণি ও পেশার মানুষ চাপে আছে। চিকিৎসক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, বিচারক, রিক্সাচালক, দিনমজুর, গৃহিনী, ছাত্র-শিক্ষক সহ সব পেশা শ্রেণির মানুষের ওপর গভীর মানসিক চাপ তৈরি করেছে মহামারি করোনা। এমনই জানা যায় সন্তানের আক্রান্তের খবরে মানসিক চাপে হঠাৎই মৃত্যু ঘটেছে পিতার। এ যখন পরিস্থিতি তখন বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারির প্রভাব ইতিমধ্যে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা, সংক্রমণ ভীতি, পরিবারের সদস্য হারানোর দুঃখ-কষ্ট এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপার্জনও চাকরি হারানোর ভয়।’ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারির আগের অবস্থার তুলনায় গেল এপ্রিলে ইথিওপিয়ার মানুষের মধ্যে বিষন্নতা ৩ গুণ বেড়েছে। কানাডায় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মদ্যপান বেড়েছে ২০ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকারীদের ৩২ শতাংশ বলছে মহামারি মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ করেছে। ইতালি ও স্পেনে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে দেখা স্বাস্থ্য সমস্যার তুলনায় চিকিৎসার আয়োজন ও চিকিৎসক কম। মহামারির কারণে মানসিক চিকিৎসাও বাধাগ্রস্থ হয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে বহির্বিভাগে মহামারি শুরুর আগে দৈনিক গড়ে ৩০০ রোগী চিকিৎসার জন্য আসতেন। বর্তমানে তা অর্ধেকে কমে গেছে। এ থেকে বুঝা যায় মানসিক রোগীরা সেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকছে, অন্যদিকে করোনা নতুন মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। এ নিয়ে গবেষণা চলছে। মনোরোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সূত্রে জানা যায়, করোনার প্রভাব বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পড়ছে। যার ভাতের সংস্থান আছে তিনি হয়তো করোনার কারণে ঘুম না হওয়ার দুশ্চিন্তায় আছেন। যার দারিদ্র বেড়েছে তিনি ভাতের চিন্তায় আছেন। মহামারি শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষকে নতুন বাস্তবতা নতুন মানসিক সংকটের মধ্যে ফেলেছে। করোনার কারণে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে ঘরে, শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না, পরিবারের সদস্য, প্রিয়জন, বন্ধু সহকর্মী, সহপাঠীদের সঙ্গে রাখতে হচ্ছে শারীরিকভাবে দূরত্ব – সে কারণে মেলামেশা করা থেকে মানুষ দূরে থাকছেÑএ কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে মানুষ। সামাজিক দুরত্ব-অভাব-অনটন-চাকুরী ও কর্মহীনতার কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপে বাড়ছে অস্থিরতা অশান্তি, হানাহানি ও দুর্ঘটনা। তাছাড়া মহামারি মোকাবিলার সামনের সারির কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মহামারির মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাটিও বৈশি^ক। এ বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব ৩টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাহলো ‘মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, উন্নতি ও যতেœ গোটা সমাজকে যুক্ত করতে হবে; মানসিক স্বাস্থ্যে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে; করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে।’ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে নীতিগত পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দেশিকাও তৈরি করেছি। বাংলাদেশের করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে। করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যখন গভীর হচ্ছে তখন দেখা যায় বজ্রপাতের মত স্বাস্থ্যে কেলেংকারির কিছু ঘটনা।
সম্প্রতি কিছু অনিয়মে দেখা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সাইন বোর্ড সর্বস্ব হাসপাতাল ও বিভিন্ন ভূয়া প্রতিষ্ঠানকে করোনা চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেকেজির জালিয়াতির ঘটনায় প্রতারনার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে সাবরিনা। চিকিৎসার নামে প্রতারণার ঘটনা রিজেন্ট হাসপাতাল ৬ জুলাই ২০২০ খ্রি. সিলগালা করা হয়েছে। এই হাসপাতালে চেয়ারম্যান মো: সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে খুঁছে পুলিশ। গত ১২ জুলাই ৫ প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমোদন বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাহলো কেয়ার মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, স্টেমজ হেলথ কেয়ার, থাইমোকেয়ার ডায়াগনস্টিক এবং চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার।
লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের অপকর্ম প্রকাশ হওয়ার পর মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। যার কুফল দেশবাসীকে ভোগ করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তার অধীন সকল অধিদপ্তর ও পরিদপ্তর সহ সকলে মিলে মিশে কাজ করে দেশের এ দুঃসময়ে মানুষের পাশে থাকতে হবে। যারা যারা মানুষের জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের আখের ঘুচানোর মত অপকর্মে লিপ্ত তাদেরকে দ্রæত আইনের আওতায় এনে শান্তি নিশ্চিত করা হলেই স্বাস্থ্যের কেলেংকারি কমতে পারে বলে আমাদের প্রত্যাশা। আমরা আশা করি মানবিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সবদিকে কান খোলা রেখে অসৎ ব্যক্তি, দুষ্টচক্র ও মানবতার দুশমনদের কালো হাত চিরতরে ভেঙে দিয়ে স্বাস্থ্যসেবার সুনাম ও সুখ্যাতি ফিরিয়ে আনবেন।

লেখক : স্বাস্থ্য-শিক্ষা কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন