প্রসঙ্গ : ইয়াজুজ মাজুজ

41

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

‘ইয়াজুজ মাজুজ’ হলো হযরত নুহ (আ.)’র সন্তান ইয়াফস ইবনে নুহ (আ.)’র বংশের লোক। শব্দ দুটি আরবী হতে উৎপন্ন। অর্থ অগ্নির লেলিহান। এ গোত্রদ্বয় মানুষ ছিল অন্যগোত্রের চেয়ে অধিক তাই তাদের অস্থির বিকৃতিকে লেলিহান অগ্নির সাথে তুলনা করা হয়েছে। তারা দ্রæত চলাফেরা করতো এবং অস্থির জাতি ছিল।
তাওয়াত কিতাব ও পবিত্র কোরআনে ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে বর্ণনা আছে। অধিকাংশ সময় তারা খুন অপকর্মে লিপ্ত থাকতো বলে তাদের এ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তাদের একটি গোত্রকে পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্তে বিশৃঙ্খলা ও মানব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করলে হযরত যুলকারনায়ন তাদেরকে দেয়ালাবদ্ধ করে দেয় যাতে তারা মানুষের ক্ষতি করতে না পারে।
কোন কোন লেখক বলেছেন, মহাপ্রলয়ের দিন হযরত ইসরাফীল (আ.)’র শৃংগায় ফুঁ প্রদানের পর মানুষ অস্থির হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে ছুটে যাবে, সে অবস্থার ভিত্তিতে মানব জাতিকে ইয়াজুজ মাজুজ বলা হয়েছে। কোন কোন আলেম বর্ণনা করেছেন, ইয়াজুজ মাজুজ দুটি সম্প্রদায়ের নাম। তাদের সংখ্যা সম্পর্কে মতান্তর রয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন আকৃতিতে আল্লাহপাক জাল্লে শানহু সৃষ্টি করেছেন। তাদের কেউ কেউ অনেক লম্বা, আবার কেউ কেউ অনেক খাটো কিন্তু তাদের চরিত্র মানুষের মত নয়, পশুর মত। তারা এক সময় পথে প্রান্তরে অত্যাচার ব্যভিচারে নিয়োজিত হতো। তাদের সাথে থাকতো বিভিন্ন প্রকারের লোক। ইয়াজুজ মাজুজের কান ছিল বড় বড়। তাদের একটি কান বিছিয়ে শয়ন করতো আরেকটি কান শরীরের ওপর দিতো।
বিশিষ্ট গবেষক মুখতার কাউমির মতে, ইয়াজুজ হচ্ছে তাতারী সম্প্রদায় আর মাজুজ হচ্ছে মোঘল জাতি। এ দু’টি সম্প্রদায় পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছে। এক্ষেত্রে তাতারদের প্রসিদ্ধ লাভ হয়েছে তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে। মূলত তারা উভয় গোত্র একই পুরুষ তুর্কীদের অন্তর্ভুক্ত। মধ্য এশিয়ার উচ্চভূমি হতে তারা নি¤œভূমিতে নেমে আসে এবং চীন ও মাঞ্জুরিয়ায় বসবাস করতে থাকে। এরপর তারা উত্তরের পাহাড় বেষ্টিত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তাদের রাজত্ব তুর্কিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। তারা তাদের পাশর্^বর্তী জাতি গোষ্ঠির ওপর ব্যাপক অত্যাচার ও হামলা চালিয়ৈ পৃর্থিবীতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে চেঙ্গিসখান অধিক প্রসিদ্ধিলাভ করে। সে প্রথমে চীন পদানত করে। তারপর ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে হামলা চালায় এবং খাওয়ারিজম তথা মধ্য এশিয়ার রাজা কুতুব উদ্দিনকে পরাস্ত করে। অতঃপর তার বংশধররা সমগ্র এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এরপর তারা তাদের বিজিত রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাদের চারটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাদের অন্যতম হালাকুখান পারস্য, বাগদাদ ও সিরায় ধ্বংস করে তার সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। (সূত্র : মাউসুআতুল আল ফাজিল কোরানিয়্যাহ, পৃ: ৮৪০)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক সূরা কাহ্কে যুলকারনায়নের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যুলকারনায়ন উত্তরদিকে তাঁর একটি অভিযান পরিচালনাকালে দু’টি প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছার পর এমন এক মানবগোষ্ঠীর সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। তাদের ভাষা তাঁর নিকট দুর্বোধ্য ছিল। পরে দোভাষীর মাধ্যমে তার সাথে তাদের কথা হয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করেছেন, ‘তারা বললো হো যুলকারনায়ন ! ইয়াজুজ মাজুজ এদেশে অশান্তি সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় আমরা কি আপনার জন্য কিছু করা সংগ্রহ করবো ? আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিবেন। (আল কোরআন : ১৮ : ৯৪)
যুলকারনায়ন তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করে উঁচু সুদৃঢ় দেয়াল নির্মাণ করে দেন। এই দেয়াল সম্পর্কে আবু রায়হান আল বিরুনী অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এটি পৃথিবীর উত্তর পশ্চিম অংশে অবস্থিত।
কোন কোন গবেষক বলেছেন, কাম্পিয়ান সাগরের পশ্চিম তীরে দারবন্দ নামের একটি প্রাচীন শহর আছে। ককেশাস পর্বতমালা যেখানে শেষ হয়েছে এবং কাম্পিয়ান সাগরে মিলিত হয়েছে সেখানেই শহরটি অবস্থিত। প্রাচীরটি কাম্পিয়ান সাগর থেকে আরম্ভ করে আনুমানিক ত্রিশ মাইল দূর পর্যন্ত পশ্চিমে শেষ হয়েছে। এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে বললো ‘আমি প্রাচীরটি দেখেছি। এটি দেখতে সৃদুশ্য পাড় বিশিষ্ট চাদরের ন্যায়’। নবীজী বললেন, ‘তুমি সেটি দেখেছো ? (বোখারী শরীফ)
হযরত ওমর ফারুক (রা.)’র শাসনামলে মুসলমানগণ আরমেনিয়ায় যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন এবং কাবুল পর্যন্ত বিজয়ী হন। সেখানে পরিদর্শকগণ যে প্রাচীর দেখতে পান কেউ কেউ এটি বর্ণিত প্রাচীর মনে করেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা কয়েক জাতি-গোষ্ঠীর, তাদের প্রত্যেক জাতিতে চার লক্ষ লোক রয়েছে। তাদের একজন লোকের মৃত্যু হলে তার ওরষ হতে এক হাজার লোক রেখে যায়। তারা আদমের বংশধর। পৃথিবী ধ্বংসের জন্য তারা বেরিয়ে পড়বে। তাদের মুখ থাকবে সিরিয়ায় পা থাকবে ইরাকে’।
হাদিসে পাকে আরো বর্ণনা আছে, কিয়ামতের পূর্বে ইয়াজুজ মাজুজ উত্থান ও নির্গমনকে কিয়ামতের দশ আলামতের একটি বলেছেন। এ কথার মধ্যে দিয়ে আত্মস্থ হয় যে, তারা পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে।
আরেক বর্ণনায় জানা গেছে যে, হযরত যুলকারনায়ন তাদেরকে প্রাচীনবদ্ধ করে রেখেছেন। কিয়ামতের পূর্বে হযরত ইসা (আ.) নাজিল হওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। ইসা (আ.) মুসলমানগণকে নিয়ে তুর পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। এরা পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস করে দিবে। মুসলমানদের মাঝে খাদ্যসামগ্রীর অভাব দেখা দিলে হযরত ইসা (আ.) মুসলমানদের জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ পাক মহামারী আকারে রোগ দিয়ে তাদের মৃত্যু ঘটাবে। লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হবে। এরপর আল্লাহপাক বৃষ্টির পানি দ্বারা জমিন পরিস্কার করবেন। পৃথবী আবার ফুলে ফলে ভরে উঠবে এবং হযরত ইসা (আ.) চল্লিশ বছর রাজত্ব করবেন। অতঃপর শেষ কেয়ামত সংঘটিত হবে।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক