প্রসঙ্গ : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১

23

এমরান চৌধুরী

সত্তরের দশকে আমরা যখন স্কুল-কলেজের ছাত্র তখন দুটো প্রবন্ধ খুব করে পড়েছি। রসঘন এ দুটো প্রবন্ধের সারমর্ম ছিল মানুষকে বই কেনা আর বই পড়ায় উৎসাহিত করা। তার একটি ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর “বই কেনা”, অন্যটি প্রমথ চৌধুরীর “বই পড়া”। তখন বিভাগীয় পর্যায়ে গ্রন্থমেলা হতো। আর সেই মেলা উপলক্ষে প্রকাশ করা হতো সুন্দর সুন্দর পোস্টার। সেই শহর থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে গ্রামে দেয়ালের গায়ে সাঁটানো হতো, পাশাপাশি বড় বড় বৃক্ষের গায়েও শোভা পেত এই পোস্টার। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকত “ বই কিনুন, বই পড়ুন”। আবার কোনো পোস্টারে লেখা থাকত বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না। বই কিনে কেউ দেউলিয়া না হলেও বই কেনার প্রতি যে সেই সত্তরেও খুব একটা আগ্রহ ছিল না তা এ দুটো প্রবন্ধ পড়লে সহজেই বোঝা যায়। । প্রমথ চৌধুরী বাঙালির বই পড়ার দীনতা দেখে লিখেছেন, “ বই পড়া সখটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সখ হলেও আমি কাউকে শখ হিসেবে বই পড়তে পরামর্শ দিতে চাই নে। প্রথম সে পরামর্শ কেউ গ্রাহ্য করবেন না; কেননা, আমরা জাত হিসেবে শৌখিন নই। দ্বিতীয়ত অনেকে তা কুপরামর্শ মনে করবেন; কেননা আমাদের এখন ঠিক শখ করবার সময় নয়। আমাদের এই রোগ-শোক, দুঃখ-দারিদ্র্যের দেশে সুন্দর জীবন ধারণ করাই যখন হয়েছে প্রধান সমস্যা, তখন সেই জীবনকে সুন্দর করা, মহৎ করার প্রস্তাব অনেকের কাছে নিরর্থক এবং নির্মমও ঠেকবে।”
আসলেই ঠিক উপোস পেটে বই পড়া দূরে থাক কোন কাজেই মন বসার কথা নয়। তবে সেই সময়টা আমরা অনেক আগেই কাটিয়ে এসেছি। এখন খুব নগন্য সংখ্যক মানুষ ছাড়া এ দেশের মানুষের ভাতের অভাব আছে এটা মোটেই বলা যাবে না। এখন সত্যিকার অর্থে যে জিনিসটার অভাব, তাহলো নীতি ও নৈতিকতার। এখন মানুষ যেভাবে যে উপায়ে হোক ছেলেমেয়েদের কোটিপতি বানাবার স্বপ্ন দেখে। সোজা কথায় কোটিপতি হতে চায়। ফলে প্রাথমিক পর্যায় পার না হতেই আমাদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের বলতে থাকেন প্রতিটি বিষয়ে এ প্লাস চাই। তোকে, তোমাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, থিপল ই পাস করতে হবে। তারপর কোটিপতি হওয়া ঠেকায় কে? ফলে একজন শিক্ষার্থীর চোখ এ বিশাল পৃথিবী বাদ দিয়ে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় জি.পি.এ. নামক সোনার হরিণের প্রতি। তাই প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়” আমাদের শিক্ষিত স¤প্রদায় মোটের উপর বাধ্য না হলে বই স্পর্শ করেন না। ছেলেরা যে নোট পড়ে এবং ছেলের বাপেরা যে নজির পড়েন, দুই-ই বাধ্য হয়ে, অর্থাৎ পেটের দায়ে। সেইজন্য সাহিত্যচর্চা দেশে একরকম নেই বললেই হয়; কেননা, সাহিত্য সাক্ষাৎভাবে উদরপূর্তির কাজে লাগে না। বাধ্য হয়ে বই পড়ায় আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়েছি যে, কেউ স্বেচ্ছায় বই পড়লে আমরা তাকে নিষ্কর্মার দলেই ফেলে দিই।”
বই কেনা, বই পড়ার প্রতি মানুষের যতই অনিহা থাকুক, আমাদের কিন্তু বই পড়ার আহবান জানাতেই হবে। কারণ উদরপূর্তির পর মানুষের আরো একটি চাহিদা থাকে। সে চাহিদা হলো মানুষের মনের চাহিদা। অন্য কথায় তা হতে পারে মনতুষ্টি। মানুষের মনকে সরল, সচল, সরাগ ও সমৃদ্ধ করতে হলে সাহিত্য পাঠ তথা বইমুখি হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। শরীরের জন্যে যেমন সুসম খাবার প্রয়োজন তেমনি মনের বিকাশের জন্য প্রয়োজন বই। বই ছাড়া আর কোনোভাবে মনের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। বইয়ের মাধ্যমেই সম্ভব একমাত্র মনতুষ্টি। এ মনতুষ্টি ছাড়া পরিবার, সমাজ, দেশ সর্বোপরি জাতির প্রাণপ্রবাহ সম্পূর্ণ হতে পারে না। কেননা, বইয়ের মধ্যেই রয়েছে মানুষের দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মনীতি, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-নৈরাশ্য, সত্য ও স্বপ্নের কথা। অপরাপর শাস্ত্রের ভেতর যা-ই থাক তা একজন মানুষকে সত্য ও সুন্দর পরিপূর্ণ স্বাদ দিতে পারে না। জীবনের খÐিত কোনো অংশকে নয়, পুরো জীবনকে জানতে হলে, বুঝতে হলে, বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের অবশ্যই বইয়ের দ্বারস্থ হতে হবে।
এই বইয়ের দ্বারস্থ করতে, বই কেনা ও বই পড়ার প্রতি মানুষের মনে আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃজনে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলার। বাঙালির স্বাধীকারের প্রথম পাঠ ভাষা আন্দোলনের মাস, আবেগের মাস, আমার ভাইয়ের রক্ত ঝরানোর মাসে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এই বইমেলা। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, কোনো কোনো জেলায়, এমনকি কোনো কোনো উপজেলায় এই বইমেলার আয়োজন হয়েছে। কোথাও সরকারি ব্যবস্থাপনায়, কোথাও সৃজনশীল সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় করা হয়ে থাকে বইমেলার আয়োজন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে বইমেলার সূচনা হয় সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবিদের উদ্যোগে। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয় চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদ। গত কয়েক বছর ধরে এই মেলা আয়োজন করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং সহযোগিতা করছে সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদ ও চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী ও মিডিয়া।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বইমেলাটি হয় ঢাকায়, অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরের এই মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদের সহযোগিতায় আয়োজিত এই মেলাটি এই বছরও যথানিয়মে বসার কথা ছিল। তার জন্যে আবেদন প্রক্রিয়াসহ অনেক কাজ এগিয়েও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলা একাডেমি ইতিমধ্যে এবারের আয়োজন স্থগিত করেছে। মেলা স্থগিত হওয়ায় খবর প্রকাশের সাথে সাথে প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। উল্লেখ্য এই প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা মোটের ওপর কম নয়। দেশের বড় বড় শহরের ছাপাখানা, বাইন্ডিং খানাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে এই বইমেলাকে সামনে রেখেই কাজ করে। ফলে বইমেলা স্থগিত হওয়ায় পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে, হচ্ছে, সামনে আরও হবে। তাঁদের এই প্রতিক্রিয়ায় যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো কিছু বন্ধ নেই। হাট-বাজার, বিবাহ অনুষ্ঠান, মেজবান, পাবলিক যানবাহনে ঠাসাঠাসি করে চলাফেরা করা গেলে বইমেলা আয়োজনে অসুবিধা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে নানা রকম। আসতে পারে নানা যুক্তি। আমরা সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলতে চাই, বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে যেটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ ও ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্থগিত করেছেন। তবে এটাও ঠিক স্থগিত মানে বাতিল করা নয়। ফেব্রæয়ারি মাস চলে গেলে ভাষার মাসের আবেগ হয়তো থাকবে না। ফেব্রæয়ারির পরেই আছে আমাদের স্বাধীনতার মাস, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর শেষ মাস। আর তাই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে স্বাধীনতার মাসে স্বাধীনতার বইমেলা, তাও যদি সম্ভব না হয় এপ্রিল মাসে বাংলা নববর্ষকে সামনে সীমিত সময়ের জন্য হলেও বইমেলার আয়োজন করার জন্য বাংলা একাডেমিকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। তাঁদের মনে রাখতে হবে বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজি। এই একটি মেলাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। মুদ্রিত হয়েছে হাজার হাজার বই। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরও হাজার হাজার। সুতরাং বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা যেমন জরুরি তেমনি প্রকাশনাশিল্পের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখাও সমান জরুরি। এই অবস্থায় গতকাল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বইমেলা নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলা একাডেমি ও জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রতি বছরের ন্যায় একই নিয়মে বইমেলা অনুষ্ঠানের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বইমেলা শুরুর তিনটি সম্ভাব্য তারিখও জানানো হয়। আমরা আশা করব বাংলা একাডেমি ২০ ফেব্রæয়ারি, ৭ মার্চ ও ১৭ মার্চ যে তারিখটি সরকার নির্ধারণ করবেন সেটিকে সামনে রেখে আজ থেকেই তাদের যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবেন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক