প্রশ্ন অনেক, তবুও দিগন্ত ছোঁয়ার আশা

36

রাহুল দাশ নয়ন

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছাড়া মিলবে না রেল টিকিট। টিকিট সংগ্রহের পরেও যাত্রাপথে এনআইডি সঙ্গে রাখতে হবে। কালোবাজারি ঠেকাতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন নিয়মেই অগ্রিম ১ মার্চের টিকিট বিক্রি শুরু হবে। অর্থাৎ ১ মার্চ থেকে নতুন নিয়মেই যাত্রীদের এনআইডি সাথে নিয়েই ট্রেনযাত্রা করতে হবে। এ নিয়ম ঘোষণার পর থেকেই অনলাইনে যাত্রীদের একাউন্ট ভেরিফাই ও নিবন্ধনের হিড়িক চলছে।
এ সিস্টেমে অনলাইনে টিকিট কাটলে তা অনলাইনে ফেরত (রিফান্ড) দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ নিয়ম ধরে রাখা গেলে রেল সেবা নতুন দিগন্ত ছোঁয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছতা বাড়বে বলেই মনে করছেন রেল সংশ্লিস্টরা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘যাত্রীদের ভ্রমণ নিরাপদ করতে আমরা কাজ করছি। কালোবাজারে যাতে টিকিট বিক্রি বন্ধ হয় সেটি নিশ্চিত করতে চাই। টিকিট নিয়ে যেসব সমস্যা হয় সেগুলো থেকে উত্তরণেই এনআইডি ছাড়া টিকিট বিক্রি বন্ধ হচ্ছে। এ সিস্টেমে সফলতা আসলে স্বচ্ছতা বাড়বে। শৃঙ্খলার মধ্যে মানুষ টিকিট পাবে। টিকিটে স্বচ্ছতা ফিরলেই যাত্রীদের হয়রানি ও ভোগান্তি কমবে। এ সিস্টেমে কিছু কিছু সমস্যার কথাও শোনা যাচ্ছে। সমস্যাগুলো আমরা এড্রেস করছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এগুলো নিরসন করার চেষ্টা করছি। ধাপে ধাপে সব সমস্যার সমাধানও করা হবে।’
রেল সেবা সহজীকরণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এমন সিস্টেম অনেক আগে থেকে চালু থাকলেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এনআইডি নিয়ে টিকিট কাটার বাধ্যবাধকতা করায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
তবে রেলের নিয়মিত যাত্রীরা বলছেন, প্রথমদিকে একটু সিস্টেম জটিলতার সম্মুখিন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও রেল সেবায় এটিই বাস্তবিক নিয়ম। এ নিয়ম মানা হলে টিকিট কালোবাজারি কমে যাবে। টিকিট বিক্রি ও যাত্রাপথে নতুন নিয়মের সফলতা মিললে রেল সেবা নতুন দিগন্ত ছুঁবে।
রেল সেবা নিয়ে সোচ্চার থাকা সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন রেলের এ সেবাটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তিনি ফেসবুকে নতুন সিস্টেমটিতে রেলের ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে বলেই আশা করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, টিকিট কালোবাজারি দূর করার একমাত্র পথ হচ্ছে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ নীতি বাস্তবায়ন করা। রেলে এ নীতি বাস্তবায়নে ২০২০ সালে চিঠিও দিয়েছিলাম। নতুন নিয়মে টিকিট বিক্রির ঘোষণার সাথে সাথেই টিকিট কারোবাজারিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ সিস্টেম যাতে বাস্তবায়ন না হয়, সেজন্য তারা নানা কাহিনী, নানা সমস্যার কথা তুলে ধরবে। জনগণের অসুবিধার নানা অজুহাত তুলে ধরবে। একটি নতুন সিস্টেম চালু করতে গেলে বিবিধ সমস্যা তৈরি হতেই পারে। সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে সৃষ্ট সমস্যা নিরসন করতে হবে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন সনদ আছে। শুধুমাত্র এটি নিয়ে টিকিট কাটবে এবং যাত্রাপথে এটির কপি সাথে রাখবে। ট্রেন যাত্রায় টিকিট আছে কিনা সেটি চেক করবে অনলাইনে। টিকিট ছাড়া কেউ অন্যের টিকিট নিয়ে যাত্রা করলে প্রচলিত আইনে জরিমানা করা হবে। এতে টিকিট কালোবাজারি একদম কমে যাবে। অনেকেই এ সুন্দর সিস্টেম নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে সহজ বিষয়টিকে জটিল বানাচ্ছে। প্রথমদিকে একটু জটিল মনে হলেও পরে দেখা যাবে উদ্যোগের অভাবে সহজ বিষয়টিই লুকানো ছিল। অথচ এ সিস্টেম বিশ্বের অনেক দেশে চালু আছে। পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতেও এনআইডি নিয়ে টিকিট কাটতে হয়। বিদেশিদের পাসপোর্ট কপি দিয়ে টিকিট নিতে হয়। মূলত এ সিস্টেমটিই দেশে চালু হতে যাচ্ছে।
এদিকে এ সিস্টেমটি চালু হওয়ার খবরে রেল একাউন্ট ভেরিফাই ও নিবন্ধন কার্যক্রমে গতি ফিরেছে। অনেকেই রেলওয়ের বেধে দেয়া সিস্টেম মেনে নিবন্ধন করে নিচ্ছে। প্রতিদিনই প্রচুর মানুষ এনআইডি ভেরিফাই ও নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। রেলওয়ে পক্ষ থেকেও এনআইডি ছাড়া ট্রেনযাত্রায় নিরুৎসাহিত করতে সচেতনতামূলক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যাত্রীদের প্রতি আটটি নির্দেশনা ও শর্তাবলী দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে। তবে নতুন নিয়মের সফলতা পেতে হলে যাত্রী, রেলকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতাও প্রয়োজন।
রেলওয়েতে কর্মরত পরিবহন বিভাগের কর্মচারীরা বলেন, যাত্রী ও রেলকর্মীরা এতদিনের পুরনো অভ্যাস বদলে ফেলবে- এমনটা আশা না করাই ভালো। নতুন বিষয় শুরু হলে কিছুটা সময় দিতে হবে। একটি ট্রেনে কমপক্ষে আসনসহ এবং আসন ছাড়া দেড় হাজারের উপরে যাত্রী থাকে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলো লোকাল ট্রেনের মত বিভিন্ন জায়গায় স্টপেজ দেওয়ার কারণে আধঘন্টা পরপর যাত্রী উঠতেই থাকে। এক-দুইজন টিটিই’র পক্ষে এতগুলো এনআইডি চেক করা কখনই সম্ভব নয়। ঢাকাগামী ট্রেনগুলোতে শতভাগ এনআইডি চেক করা সম্ভব হলেও লোকাল ট্রেনগুলোতে এটি আশা করা সম্পূর্ণ বোকামি।
বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত সুজায়েত উল্লাহ নামে ট্রেনের এক যাত্রী বলেন, সবকিছু সহজভাবে নিলে সহজ, নয়তো কঠিনই হবে। রেলওয়ের এ উদ্যোগটি ভালো। টিকিট কাটতে গেলে এনআইডি থাকাটা উচিত। এটা হলে যাত্রীদের পরিচয়ও রেলওয়েতে সংরক্ষণ থাকবে। কালোবাজারি তাড়াতে হলে এটির বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আবার প্রশ্ন যেগুলো উঠছে সেগুলোরও সমাধান দিতে হবে। সবার এনআইডি নিয়ে টিকিট কাটতে গেলে কিছুটা জটিলতা দেখা দিতে পারে। আবার অনেক পরিবারে হয়তো যাত্রী থাকবে চারজন, দেখা যাবে একজনের এনআইডি কিংবা জন্মসনদ নেই। তাহলে এ যাত্রী কীভাবে পরিবারের সাথে যাত্রা করবে, এসব বিষয় ক্লিয়ার করতে হবে। তবে সব প্রশ্ন সমাধান করে উদ্যোগটি সফল হোক সেই আশাই করছি।