প্রমত্ত পদ্মায় এখন জোৎস্নার আলো

72

 

প্রমত্ত পদ্মায় এখন জোৎস্নার আলো। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বহু প্রতিক্ষিত ও বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর দ্বার ২৫ জুন উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ মাহেন্দ্রক্ষণে মাননীয প্রধানমন্ত্রীকে জানাই অভিবাদন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম দৃষ্টিনন্দন পদ্মা বহুমুখী সড়ক ও রেলসেতু। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু ইতিহাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে মহান সংসদে অর্থসংস্থানের রূপরেখা দিয়েছিলেন এবং তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছিলেন, পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে, তবে তা নিজস্ব অর্থায়নে। এই সেতু দেশপ্রেমে বলীয়ান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাহসিকতা, দুরদর্শিতা, প্রত্যয় ও দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি। তিনি বিশ্ববাসী দেখিয়ে দিয়েছেন দৃঢ়তা ও একাগ্রতা থাকলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। ঝিনুক দিয়ে সমুদ্র সেঁচার মতো অসাধ্য সাধন করেছেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আমাদের মর্যাদার, আত্মসম্মানের, সক্ষমতার ইতিহাস রচিত হয়েছে। আর সে ইতিহাসের রচিয়িতা সাহসী নায়ক সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। যার কারণে আজ দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ গর্ব নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু সহায়ক ভ‚মিকা রাখবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতু এক উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে থাকবে।
পদ্মা-ব্রক্ষপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১৮.১০ মিটার প্রস্থ দেশের সর্ববৃহৎ দ্বিতল পদ্মা সেতু। দুই প্রান্তের ছয়লেনের সংযোগ সড়ক ৩.৬৮ কিলোমিটার সবমিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.৮৩ কিলোমিটার। এ সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত এই সেতু। বিশ্বে প্রথম ট্রাস সেতুটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়কপথ এবং নীচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন সুবিধা সমৃদ্ধ পদ্মা সেতুর এক অংশ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত হয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশে সংযোগ ঘটেছে। পাইলিং করা প্রক্কালে সেতু নির্মাণকরি প্রকৌশলী ও বিশেজ্ঞদের নদীর তলদেশে মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছিল। তাই ‘ক্রিন গ্রাউটিং’ পদ্ধতিতে বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর বেশ কিছু পিলার। এই পদ্ধতি প্রয়োগের বিশ্বে বাংলাদেশে প্রথম। প্রমত্ত পদ্মা নদীর বিশালত্ব ও ভয়ংকর রূপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাজান নদীর চেয়ে খরস্রোতা পদ্মায় স্রোত বেশি ছিল বলে কাজে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিল বিধায় তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে পদ্মা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের উদ্যেগ নেন। ১৯৯৯ সালে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শুরু হয়। তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৭ সালে প্রকল্পটি সরকারের অনুমোদন পায় এবং ২০০৯ সালে সেতুর নক্শা প্রণয়ন হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সেতু কতৃপক্ষ প্রকল্পের জন্য প্রাক যোগ্যতা দরপত্র আহবান করে। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হলেও কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা ২০১২ সালের ৩০ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে। তবে আদালতে উক্ত অভিযোগ উঠলেও তা প্রমাণিত না হওয়ায় কানাডীয় আদালত সংশ্লিষ্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়। ২০১২ সালের জুলাইয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন যে, বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিলে সেতু পদ্মা নির্মাণ করবে। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের মেজর ব্রিজ কোপনি কার্যাদেশ পাওয়ায় ২০১৪ সালের ১৭ জুন সেতু নির্মাণে আনুষ্ঠিক চুক্তি হয় বাংলাদেশ সরকার ও চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। আশা নিরাশার দোলাচালে বিভিন্ন বাধা বিপত্তির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি কাজ উদ্বোধনের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়। জাজিরা প্রান্তে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুতে প্রথম স্প্যান স্থাপন হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর মোট পিলার ৪২টি। সেতু চালু করার সরকারের লক্ষ্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে থাকলেও প্রাকৃতিক ও কারিগরি বাধায় তা সম্ভব হয়নি ২০২২সালের জুন মাসে সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। শেখ হাসিনা সেতু নামকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব করলেও তিনি তা অনুমোদন না করে পদ্মা সেতু রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন।
কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পুরন হয়েছে। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিক এ সেতু দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের অন্যতম যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন অধ্যয়ের সূচনা হবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এবং দেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে এক অন্যন্য অবদান রাখবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভূটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলাকে সড়কপথে রাজধানীর সাথে যুক্ত করবে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনীতির দ্বার উন্মোচিত হবে। এই সেতু অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ, আধুনিক চিকিৎসা, শিক্ষা, দারিদ্র বিমোচন এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। সেতুটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১৭হাজার বর্গমাইল বা দেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চল জুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানীর দুরত্ব কমবে ১০০ কি.মি.।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ-নদী। তাঁর মধ্যে খরস্রোতা ও অশান্ত পদ্মা অন্যতম। দেশের মধ্যভাগ ও পূর্বাঞ্চালের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বড় বাধা পদ্মা পারাপার। আর পদ্মায় যানবাহন পারাপারের মাধ্যম ছিল ফেরি। মানুষ পারাপারের মাধ্যম লঞ্চ, ট্রলার, বা নৌকা। নৌযানে নদীটি পাড়ি এই সর্বনাশা পদ্মার নদী গর্ভে অনেকের সলিল সমাধিও হয়েছে কিন্তু সে সব দুর্ভোগ অবসান ঘটিয়ে পদ্মা সেতু সারা দেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতোয় আবদ্ধ করেছে। এখন আর জনগণকে ফেরি বা নৌযানের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে না। স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। তাই আজ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মাঝে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। তাঁরা এই সেতুকে কেন্দ্র করে মনে মনে স্বপ্ন বুনছে।

লেখক : কলামিস্ট, রাজনীতিক