প্রবাসীদের ভাবমূর্তি রক্ষায় প্রয়োজন সরকারের গঠনমূলক উদ্যোগ

17

সাইফুল ইসলাম তালুকদার

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের কোটি মানুষ এখন নানা পেশায় জড়িত। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যেই বেশি বাংলাদেশি কাজ করছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত থাকলেও অধিকাংশই শ্রমিকের কাজ করে থাকেন। এসব প্রবাসীরা ব্যাপক সুনামের সাথে কাজ করে দেশের রেমিটেন্স প্রবাহকে সচল রাখছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিয়মকানুন বেশ কঠিন। পান থেকে চুন খসলেই জরিমানা থেকে শুরু করে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়। এজন্য এখানে সবাই নিয়ম মেনে চলেন। বাংলাদেশিরাও এর বাইরে নয়। আইনি ঝামেলা আর আর্থিক জরিমানা এড়াতে সবাই সরকারের নিয়ম মানতে একপ্রকার বাধ্য।
কিন্তু এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে গেলে সরকারের সব নিয়ম মানেন! আমি বলবো মানেন না। কারণ কি? আমাদের দেশে আইন আছে, আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই হয়তো এই জন্য। অথবা বিদেশে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু দেশের আইনের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই। অন্যথায় বিদেশে আপনি একদম লাইনে থাকেন আর দেশে আসলে পুরো উল্টো লাইনে।
একবার আমি দেশে যাওয়ার সময় বিমান ঢাকা ল্যান্ড করে। যাত্রীরা প্রায় সবাই বাংলাদেশের। বিমান ল্যান্ড করার পরপরই সবাই হুড়োহুড়ি শুরু করে ব্যাগ নেয়ার জন্য। কেবিন ক্রুরা বিমান পুরোপুরি থামার পরে ব্যাগ নেয়ার অনুরোধ জানাতে থাকে বারবার। কিন্তু কে শোনে কার কথা! একজন পেছন থেকে বলছে, বিদেশে অনেক আইন মানছি, এবার একটু শান্তিতে চলি। কেন ভাই, নিয়ম মেনে চললে কি অশান্তি ভর করে! নাকি বিদেশের আইন মানায় শান্তি আর দেশে আইন মানতে ব্যাপক অ্যালার্জি।
এছাড়া দেখেন, উন্নত দেশগুলোতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই। সবাই লাল আর সবুজ বাতির ওপর নির্ভরশীল। নিয়ম না মানলেই জরিমানা। বাধ্য ছেলের মত সবাই নিয়ম মেনেই গাড়ি চালাচ্ছেন। অথচ এই লোকদের অনেকে দেশে গেলে পুলিশ সার্জেন্টকে ফাঁকি দিয়ে চেষ্টা করেন দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যেতে। বিদেশে নির্ধারিত সময়ের পর অফিসে গেলে বেতন কাটার বিধান রয়েছে। ঝামেলা এড়াতে সবাই নির্ধারিত সময়ে কাজে যায়। আর দেশে গেলে আমরা চেষ্টা করি বসকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে নিজের মত অফিস করা যায়। মোটকথা আমরা সবাই নিয়ম মানি, যেখানে প্রেসার পড়ে। বিদেশে লাঠি কিংবা জরিমানার ভয়ে নিয়মটা ঠিকই মানি। কিন্তু নিজ দেশেই অবহেলা। সকলে দেশপ্রেমের কথা বলেন। কিন্তু মনে সবার দেশপ্রেম থাকলে দেশের নিয়মটা ঠিকমতই মানতো।
তবে, যাদের নিয়ম না মানার অভ্যাস, তারা সব জায়গায় প্রায় একইরকম থাকেন। যেমন আরব আমিরাতে অনেকেই আছেন রাস্তায় পানের পিক ফেলে, চিপস কিংবা বিস্কুটের প্যাকেট রাস্তায় ফেলে দেন। এতে জরিমানার বিধান থাকলেও তারা থোরাই কেয়ার করেন আইনের প্রতি। অনেকে আবার জরিমানাও দিচ্ছেন। কিন্তু সংশোধন হচ্ছেন না। এতে তাদের নিজের বদনামের পাশাপাশি সম্মানহানি হচ্ছে দেশেরও। এর আগে কিছু অনিয়মের’ জন্য বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের ভিসা দিচ্ছিল না আরব আমিরাত সরকার। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর ভিসা চালু হলেও এখনো বাংলাদেশ আরব আমিরাতের গুড লিস্টে নেই।
এছাড়া তুচ্ছ ঘটনায় নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে অনেক বাংলাদেশি। শারজার রোলা আলাইন সহ বিভিন্ন শহরে নিজেদের মধ্যে প্রায় মারামারির ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গিয়েছে। অনেকে সামর্থ্য না থাকার পরও ইনভেস্টর ভিসা লাগিয়ে নানা অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
অনেকে আবার মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেক বাংলাদেশির কাছে এসব মাদক বিক্রি করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একাধিকবার অভিযান চালিয়েছেন। অনেকে থানাহাজতে গিয়েছেন, সতর্ক করা হয়েছে, এরপরও যে লাউ সে কদু। কেউ কেউ এখানে আইন মানে না বাধ্য হয়ে, কিন্তু কিছু লোক আছে তারা দেশে কিংবা বিদেশে কোথাও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও নয়। এই লোকগুলি যেমন নিজেদের বিপদ ডেকে আনেন তেমনিভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনেন।
শ্রীলংকা, নেপাল ফিলিপাইনসহ অনেক দেশের নাগরিকদের শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর আগে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। বিভিন্ন সুপার মার্কেটে শ্রীলংকা, নেপাল ও ফিলিপিন্সের মেয়েরা বিক্রয়কর্মী হিসেবে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। নিজ নিজ দেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা এসব নারী কর্মীদের বিপক্ষে কখনো কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। কিন্তু আমাদের দেশের এ ব্যাপারে কোনো ভালো গঠনমূলক উদ্যোগ নেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। এতে শুরু থেকেই আরব আমিরাতে এসে শ্রমিকরা এদেশের আইনকানুন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায় না। আইনশৃঙ্খলা না মেনে তারা একদিকে যেমন ঝামেলায় পড়ছেন তেমনিভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এজন্য এখন থেকে প্রত্যেক শ্রমিককে বিদেশে পাঠানোর আগে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারণা দেয়া, কাজে দক্ষ করে তোলা, সবদিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করছি। নিয়ম মেনে চললে শ্রমিকদের নিজেদের জীবনে যেমন লাভ হবে তেমনিভাবে ভবিষ্যতে অন্য যারা এদেশে আসবেন তাদের জন্য পথ সুগম হবে।
আরেকটা ব্যাপার, সবাই সবকিছুতে সরকারের দোষ দেই। আরে ভাই, সরকারের দোষ আছে অস্বীকার করছিনা, এর আগে আমরা নিজের কাজটা ঠিক মত করি। নিজের ভুল শুধরে আইন মেনে চলি। দেখবেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নিজে ভালোতো জগত ভালো। মনের মধ্যে দেশপ্রেম আনি। মনে রাখতে হবে, লাল-সবুজের দেশটা আমাদের সবার। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক: সভাপতি- ইউএই প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি