‘প্রবারণা’ পূর্ণিমা

11

 

‘প্রবারণা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নিমন্ত্রণ, আহবান, মিনতি,অনুরোধ, নিষেধ, সমাপ্তি, ত্যাগ, ভিক্ষুসংঘের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচারবিধি, তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি।
ধর্মীয় আবহে উদ্ভাসিত ও সুষমামন্ডিত এ পূর্ণিমা উৎসব তথাগত বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন ভিত্তিক নানান কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। মৈত্রী, করুণা ও অহিংসা মন্ত্রে আত্মনিবেদিত থেকে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘকে নিজ নিজ মন্দিরে বা প্যাগোডায় অবস্থান করে ৩ মাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করার জন্য তথাগত বুদ্ধ নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে বর্ষাব্রত পালন শুরু হয়ে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় এ বর্ষাব্রত পালন অনুষ্ঠান শেষ হয়ে থাকে।
বুদ্ধের নির্দেশনা মতে ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী সংঘ তিন মাস ধ্যান সমাধিতে মগ্ন থেকে নিজ নিজ চিত্তের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে নিজেদের মনের পরিশুদ্ধি আনয়ন করেন। তাঁদের চলার পথে কোন ধরনের দোষ ত্রæটি করে থাকলে প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষুসীমায় উপস্থিত হয়ে পারস্পরিক দোষ ত্রæটিগুলো স্বীকার করে ‘আপত্তি দেশনার’ মাধ্যমে নিজেদের চিত্তকে পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে অংগীকারবদ্ধ হবেন। তাঁরা ভিক্ষুসীমায় বসে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ পাঠ করবেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুগণের কাছ থেকে ভিক্ষুর প্রতিপালনীয় শীলগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সবিস্তারে বুঝে নেবেন। তাঁরা ৩ মাস ব্যাপী বর্ষাবাস চলাকালে বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন তত্ত¡ গবেষণা করে প্রত্যেক অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে বিহারে বা প্যাগোডায় সমবেত অষ্টশীল ও পঞ্চশীল পালনকারী উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনা প্রদান করবেন এবং দায়ক-দায়িকাগণকে চিত্তের পরিশুদ্ধতা সহকারে আত্মকল্যাণ ও পরহিত কল্যাণে নিবেদিত থাকার ব্যাপারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ প্রদান করবেন।
করুণা ঘন তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ বিধিসম্মতভাবে সত্য ধর্মকে গুরুত্ব সহকারে পালনের মাধ্যমে সুন্দর জীবন গঠনে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বিধানের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। প্রথম বর্ষাবাস শেষে তথাগত বুদ্ধ সারনাথের মৃগ দায়ে ধর্মচক্র প্রবত্তনের পর তাঁর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের যথাক্রমে ভদ্দিয়, কোন্ডায়, বপ্প, মহানাম ও অশ্বজিতকে তাঁর নব আবিষ্কৃত ধর্ম দর্শন সম্যকরূপে উপলব্ধি করে মানব কল্যাণে প্রচার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি যশ ও তাঁর বন্ধুসহ ৬০ জন অভিজ্ঞ ভিক্ষুকে এ মহান ধর্ম প্রচারের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। তিনি তাঁদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘চরতে ভিকখবে চারিকং, বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়…।’
‘হে ভিক্ষুগণ বহুজনের মংগলের জন্য,
বহুজনের কল্যাণের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, লোকের প্রতি অনুকম্পা পরবেশ হয়ে দিকে দিকে এ কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর’। তাঁর নির্দেশ মতে আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ যুক্ত ধর্ম প্রচার করার জন্য ভিক্ষু সংঘ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম মতে ১০ম বর্ষাবাসে এ পুণ্যময় পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনা প্রদান করার পর ভারতের সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন এবং মানবজাতির সুখ-শান্তি ও কল্যাণে দিকে দিকে সদ্ধর্ম প্রচারের জন্য ভিক্ষু সংঘকে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন এবং এ দিনেই তাঁর ৩ মাস বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এই ধারাবাহিকতায় আজকের আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমায় বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পর থেরবাদী বৌদ্ধ দেশসমূহে ভিক্ষু সংঘ ধর্ম প্রচারে বেরিয়ে পড়বেন। বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান শেষ হবার পরদিন থেকেই প্রতিটি মন্দির বা প্যাগোডায় দানোত্তম কঠিন চীবর দান উদযাপন শুরু হয়। যেসব মন্দিরে বা প্যাগোডায় ভিক্ষুসংঘ সুষ্ঠুভাবে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করেন কেবল সেসব মন্দিরে বা প্যাগোডায় কঠিন চীবর দান উদযাপন করার বিধান রয়েছে। আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১ মাসব্যাপী বিভিন্ন বিহারে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। একটি বিহারে বা প্যাগোডায় বছরে একবার এ পবিত্র দান উদযাপন করার বিনয়সম্মত বিধান রয়েছে।
তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থান কালে কোশল হতে একদল ভিক্ষু বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্তি শেষে বুদ্ধের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। বুদ্ধ তাঁদেরকে বললেন ‘ভিক্ষুসংঘ দীর্ঘ সময় এক স্থানে অবস্থান করলে তাঁদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, বিবাদ কলহ হওয়া টা স্বাভাবিক। বর্ষা বাস শেষ করে তোমরা একত্রিত হয়ে পরস্পর পরস্পরের দোষ ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং একে অপরকে আন্তরিকভাবে বরণ করে নিবে।’ তাই বর্ষাবাস সমাপনের পর ভিক্ষুগণ তাঁদের দোষ ত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট স্বীকার করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানান। এমনকি অজ্ঞাতসারে কোন অপরাধ করে থাকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাই হলো প্রবারণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা আকাশ প্রদীপ (ফানুস) প্রজ্বলন করে থাকেন।
কথিত আছে সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহ ত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছে সারথী ছন্দকে অশ্ব কন্থক ও শরীরের রাজকীয় পোশাকাদি দিয়ে বিদায় দেন। সুবিন্যস্ত কেশকলাপ প্রব্রজিতের জন্য শোভনীয় নয় বিধায় তিনি ডান হাতে অশি নিয়ে কেশকলাপ কর্তন করে রাজমুকুট সহ ঊর্ধ্বদিকে উড়িয়ে দেন। সত্য ক্রিয়ার প্রভাবে তাঁর কেশরাশি ঊর্ধ্বাকাশে উত্থিত হয়েছিলো। তাবতিংস স্বর্গের দেবতারা তাঁর কেশরাশি নিয়ে চুলা মণি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে লাগলেন। বাংলাদেশসহ বৌদ্ধ প্রধান দেশসমূহের বৌদ্ধরা সেই কেশ রাশির পূজা ও সম্মানার্থে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় আকাশ প্রদীপ (ফানুস) উড়িয়ে থাকেন।
প্রবারণা উৎসব ভিক্ষু সংঘের মাঝে মৈত্রী, সৌহার্দ্য ও স¤প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে। অপর দিকে এ উৎসব বৌদ্ধসহ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার মাঝে আনন্দের ভাবধারা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। তাই আজকের প্রবারণা হোক হিংসার পরিবর্তে অহিংসা, শত্রুতার পরিবর্তে মিত্রতা, ভোগের পরিবর্তে ত্যাগ, অশান্তির পরিবর্তে শান্তি, সর্বোপরি প্রেম, করুণা, সৌভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ ও মৈত্রীর সেতুবন্ধন সৃষ্টির মহান প্রেরণা। স্বার্থ-দ্বন্দ্ব ও অশান্তির বিষবাষ্পে পূর্ণ বিশ্ব হোক কালিমা মুক্ত।
লেখক: প্রাবন্ধিক