প্রধানমন্ত্রী বললেন সিদ্ধান্ত জয়ই নেবে

16

পূর্বদেশ ডেস্ক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের অনেক ধারণাই এসেছে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাথা থেকে, তবে জয় রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কিনা, সেটা নির্ভর করছে তার এবং দেশের জনগণের ওপর। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। তার ভারত সফরের আগের দিন গতকাল রবিবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছেন এএনআই।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা জয় রাজনীতিতে আসবেন কি না, সেই প্রশ্নে তার মা শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখুন, সে তো একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ। তাই এটা তার ব্যাপার। কিন্তু সে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করেছি, সেখানে স্যাটেলাইট, সাবমেরিন কেবল বা কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মত সমস্ত ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার ধারণা তার। আর আপনারা জানেন, সে (জয়) আমাকে সহায়তা করে যাচ্ছে এবং এই সে যে কাজ করে যাচ্ছে, সেজন্য দলে বা মন্ত্রণালয়ে কখনও কোনো পদ নেওয়ার কথা ভাবেনি’।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে কর্মীরা যে জয়কে দলের বড় কোনো পদে আনার জোর দাবি জানিয়েছিলেন, সে কথাও সাক্ষাৎকারে বলেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
কর্মীদের ওই দাবির পর সম্মেলনে কী ঘটেছিল, সেই বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ওকে ডেকে বললাম, তুমি মাইক্রোফোনে গিয়ে বল- তুমি কি করতে চাও। ও তখন মাইক্রোফোন নিল, বললো, ‘না, এই মুহূর্তে দলে কোনো পদ আমি চাই না। বরং যারা এখানে কাজ করছেন, তাদেরই পদ পাওয়া উচিৎ। কেন আমি একটি পদ দখলে রাখব? আমি আমার মায়ের সাথে আছি, দেশের জন্য কাজ করছি এবং মাকে সহায়তা করছি’।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তার ভাবনাগুলো এরকমই। এমন নয় যে, ওকে আমার পদ দিতে হবে বা সেরকম কিছু করতে হবে’।
দলের কর্মীদের ওই আহ্বানে জয়ের এখন সাড়া দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কি না- সেই প্রশ্ন শেখ হাসিনার কাছে রেখেছিল এএনআই। উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা নির্ভর করবে জনগণের ওপর’।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর জয় কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে। ২০১৩ মাঝামাঝি সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী জয় দেশে এসে রাজনীতি নিয়ে কথা বলে আলোচনার ঝড় তোলেন। নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে তিনি বিভিন্ন জেলা সফর করে সমাবেশ ও আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের রূপকল্প বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে বক্তব্য দেন। খবর বিডিনিউজের
সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের গবেষণা ও প্রচারণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্স অ্যান্ড ইনফরমেশনের চেয়ারম্যান। ছোট বোন সায়মা ওয়াজেদ প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারপারসন।
‘দিল্লিতে গোপনে বসবাস করেছি’:
এনএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের সঙ্গে ‘পরীক্ষিত বন্ধুত্বের’ নানা দিক নিয়েও কথা বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভ‚মিকা এবং ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।
চারদিনের ভারত সফরের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সাক্ষাৎকারে পাঁচ দশক আগে তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতির কথা তুলে ধরেন। কীভাবে হত্যাকারীরদের হাত থেকে বাঁচতে তাঁকে নাম পরিবর্তন করে এক সময় দিল্লিতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল সে কথাও তুলে ধরেন তিনি।
এক সময় দিল্লির পশ পান্ডারা রোডে নাম পরিবর্তন করে আত্মগোপন করতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। সে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় চোখ ভিজে যায় হাসিনার। তিনি জানান, ১৯৭৫ সালে তাঁর স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ এর সঙ্গে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সেই দিনটি ছিল ৩০ জুলাই। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন তার বাবা, মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। কিন্তু এটাই যে তাদের সাথে শেষ দেখা ছিল তা তিনি ভাবতেও পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী বিদেশে ছিল। তাই আমি বাবা মায়ের সঙ্গে বাড়িতে থাকতাম। আমার বাবা-মা, আমার তিন ভাই এবং দুই বোন সবাই বাড়িতে থাকতাম। তাই তারা সকলেই আমাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই শেষ দেখা ছিল। জার্মানি যাওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ পর ১৫ আগস্ট সকালে শেখ হাসিনা এমন খবর পান যে তার বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। তার বাবা কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। তার বাবার মৃত্যু সম্পর্কে জানার পরেই ভয়াবহতা থামেনি, পরিবারের আরও সদস্যদের সারসংক্ষেপে মৃত্যুদÐের খবর পেয়ে তিনি আরও মর্মাহত হন।
আবেগজড়িত কন্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য যে, কোনো বাঙালি এমন নোংরা ঘটনা ঘটাতে পারে। এবং তখনও আমরা জানতাম না কীভাবে, আসলে কী ঘটেছিল। শুধুমাত্র একটি অভ‚্যত্থান হয়েছিল এবং তারপর আমরা শুনলাম যে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি যে, পরিবারের সকল সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা স্মরণ করিয়ে দেন, তার প্রতি সাহায্য প্রসারিত করা প্রথম দেশগুলির মধ্যে একটি ভারত। তিনি বলেন, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী দ্রæত খবর পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি আমাদের নিরাপত্তা এবং আশ্রয় দিতে চান। বিশেষ করে যুগো¯øাভিয়া থেকে মার্শাল টিটো এবং মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি। আমরা এখানে (দিল্লি) ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কারণ আমাদের মধ্যে ভয় ছিল। আমরা ভাবছিলাম যে, আমরা যদি দিল্লি যাই, দিল্লি থেকে আমরা দেশে ফিরে যেতে পারব এবং তারপরে আমরা জানতে পারব পরিবারের কত সদস্য এখনও বেঁচে আছেন।
পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও হাসিনার কণ্ঠে এখনো সেই ব্যথা প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, ‘এটি একটি খুব কঠিন সময়। জার্মানিতে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীই প্রথম ব্যক্তি যিনি তার পরিবারের গণহত্যার বিবরণ দেন।
শেখ হাসিনা বর্ণনা করেন, ‘কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি জানতাম না আমি কোথায় ছিলাম। কিন্তু আমি আমার বোনের কথা ভেবেছিলাম, সে আসলে আমার থেকে ১০ বছরের ছোট। তাই, আমি ভাবলাম কিভাবে সে এটা নেবে। এটা তার জন্য খুব কঠিন। তারপর যখন আমরা দিল্লিতে ফিরে আসি, প্রথমে তারা আমাদেরকে সমস্ত নিরাপত্তাসহ একটি বাড়িতে রেখেছিল, কারণ তারাও আমাদের নিয়ে চিন্তিত ছিল।
তিনিও সম্ভাব্য টার্গেট বলে মনে করেন কি-না জানতে চাইলে হাসিনা বলেন, যে দুর্বৃত্তরা তার বাবার ওপর হামলা করেছে তারা অন্য আত্মীয়দের বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে এবং তার কিছু আত্মীয়কে হত্যা করেছে।
ষড়যন্ত্রকারীদের স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ যেন আর ক্ষমতায় না আসে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ছোট ভাইয়ের বয়স মাত্র ১০ বছর, তাই তারা তাকেও রেহাই দেয়নি। তাই আমরা যখন দিল্লিতে ফিরে আসি, তখন সম্ভবত ২৪ শে আগস্ট, তখন আমি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সাথে দেখা করি। তখন তিনি আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে দিলেন, আমার স্বামীর জন্য একটি চাকরি এবং এই পান্ডারা রোডের বাড়িটি। আমরা সেখানেই থাকলাম। সেই প্রথম ২-৩ বছর আসলে এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল, আমার সন্তান। আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র ৪ বছর। আমার মেয়ে, সে ছোট, তারা দুজনেই কান্নাকাটি করত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা শুধু আমার বাবাকেই হত্যা করেনি, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেও পাল্টে দিয়েছে। সব কিছু, শুধু একটি রাতে, সবকিছুই বদলে দিল এবং সেই খুনিরা… তারা আসলে এখনও আমাদের তাড়িত করছে।