প্রথমে ছেলে তারপর বাবাকে হত্যা

17

সবুর শুভ

প্রথমে ছেলেকে ছক করে হত্যা করা হল। হত্যাকান্ডের কোনো ক্লু পেল না ফটিকছড়ি থানা পুলিশ। পুলিশি তদন্তে ক্লান্ত বৃদ্ধ পিতা পিবিআই এর কাছে ধর্ণা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পিবিআই মামলার আসল ক্লু বের করে আনলে পুরো চক্র ফেঁসে যাবে। এ ভয়ে বৃদ্ধ পিতাকেও হত্যা করল ওই চক্রের সদস্যরা। ঠিক যেন সিনেমার কাহিনীর মতো। পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে ছেলের মতোই হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে বাবাকেও। তদন্তভার নেয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই জোড়া খুনের রহস্য বের করে আনল পিবিআই। আদালতে আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এসব হত্যাকান্ডে আত্মীয়স্বজনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্যও বের করে নিয়ে আসলেন পিবিআই এর তদন্ত কর্মকর্তা। লিজের জমি দখল নিয়ে বিরোধের জেরে প্রথমে খুন হন ফটিকছড়ির যুবক ফকির আহম্মদ (৩৩)। একপর্যায়ে নিহত ফকিরের বাবা ও হত্যা মামলার বাদী এজাহার মিয়া (৭০) পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে তদন্তের জন্য যেতে চান। আর এই খবর পাওয়ার পর তাকেও হত্যা করেন একই দুষ্কৃতকারীরা। তবে শেষমেষ পিবিআইয়ের হাতেই গ্রেপ্তার হন এই জোড়া খুনের মূল হোতারা। যুবক ফকির আহম্মদকে হত্যার পর ‘পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা’ তাকে খুন করেছে- এমন গুজব ছড়ান আসামিরা। গুজবটি ছড়ানো হয় পরিকল্পিতভাবেই। এই হত্যাকান্ডের দীর্ঘ একবছরেও থানা পুলিশ কোনো ক‚ল-কিনারা করতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় পুলিশের উপর থেকে আস্থা উঠে যায় মামলার বাদী এজাহার মিয়ার।
সম্প্রতি খাগড়াছড়ির লক্ষাছড়ি বাজার ও ফটিকছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দিনভর অভিযান চালিয়ে বাব-ছেলে খুনে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করার পর এক আসামি চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বুধবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মো. সালাহ উদ্দিন ওরফে মন্নান (২৮) ওই আসামি জবানবন্দিতে দুই খুনের বিষয়ে বিচারকের সামনে সবিস্তারে বর্ণনা করেছে। গ্রপ্তারকৃত অন্য দু’জন হলেন- মো. ফিরোজ (৩৮) ও মো. এখলাস (৩৮)। তাদের সবার বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলায় বলে জানা গেছে। আসামি এখলাস এজাহার মিয়ার বড় মেয়ে চম্পার স্বামী। এছাড়া বাকি দুই আসামি ফিরোজ ও সালাহ উদ্দিন নিহতদের নিকটাত্মীয়। আসামিদের মধ্যে মন্নান চট্টগ্রাম অ্যাডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা ইয়াসমিনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও বাকি দু’জন জবানবন্দি দেয়নি। এ কারণে দু’জনকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন একই আদালত।
এ বিষয়ে জোড়া খুনের ঘটনার দুই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কামাল আব্বাস জানান, তদন্তভার পাওয়ার পরপরই ভিকটিম এজাহারের মেয়ের জামাই এখলাসকে শনাক্ত করা হয়। পরে আরেক ভিকটিম ফকিরের সঙ্গে আগে থেকে বিরোধের তথ্য পেয়ে মন্নানকে শনাক্ত করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর চালানো হয় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে খাগড়াছড়ির পাহাড় থেকে মন্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ফিরোজ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বলে পিবিআই এর কাছে স্বীকার করে নেয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আসামি ফিরোজ ও এখলাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বুধবার সরকারি বন্ধের দিন আদালতে হাজির করার পর মন্নান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, লিজের ৯ একরের একটি জমি দখলকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর খুন হন ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নের বাসিন্দা যুবক ফকির আহম্মদ। ঘটনার দিন তিনি একটি দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। পরদিন তার গলাকাটা মরদেহ পাওয়া যায় খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী দুইদ্যা খালে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা এজাহার মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে ফটিকছড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। কিন্তু হত্যার পর আসামিরা গুজব ছড়াতে থাকেন- পাহাড়ি এক মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে ‘পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা’ ফকিরকে হত্যা করেন। গুজবে কিছুটা স্তিমিত হয়ে যায় আলোচিত এ মামলার তদন্ত। পুলিশও ধীরলয়ে তদন্ত কাজ পরিচালনা করতে থাকে। এ অবস্থায় মামলার বাদী বৃদ্ধ এজাহার মিয়া পিবিআই এর কাছে যাওয়ার তৎপরতা শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার একপর্যায়ে আসামিরা তা জেনে যান। আবার এর আগে একই এলাকায় ঢাকা থেকে তক্ষক কিনতে এসে নিখোঁজ হওয়া হেলাল উদ্দিন (৩৭) হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন করায় আসামিদের মধ্যে পিবিআই ভীতি কাজ করতো। তাদের ধারণা, পিবিআই যেকোনো মামলার রহস্য উন্মোচন করতে পারে। এ ভয় থেকে পরিকল্পিতভাবে এজাহার মিয়াকেও হত্যা করা হয়। গত ২৪ জুন হত্যা করা হয় তাকে।
এজাহার মিয়া হত্যাকান্ডের বিবরণে পিবিআই জানায়, ঘটনার দিন এজাহার মিয়া তার আরেক ছেলে ইসমাইল হোসেনকে নিয়ে বাড়ির পাশের জমি চাষাবাদ করতে যান। ইসমাইল হোসেন গরু চড়াতে থাকেন, একই সময়ে এজাহার মিয়া বীজতলায় চাষাবাদের কাজ করছিলেন। সন্ধ্যায় ইসমাইল গরু নিয়ে বাড়ি ফিরলেও তার বাবা এজাহার মিয়া আর ফেরেননি। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ঘটনার পরদিন ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নের একটি ঝোপ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এবার নিহতের স্ত্রী নাছিমা বেগম বাদী হয়ে ফটিকছড়ি থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। একই কায়দায় বাবা-ছেলে জোড়া খুনের পর নড়ে-চড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে এজাহার হত্যা মামলার তদন্ত শুরু করে পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট। ইউনিটটির পুলিশ সুপার নাজমুল হাসানের নির্দেশনায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন এসআই কামাল আব্বাস। তদন্তের কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি হত্যা মামলার আসামিদের বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন এবং মাত্র ২০ দিনের মাথায় জোড়া খুনে জড়িত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেন।
এ বিষয়ে পিবিআই চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, একেবারে পরিকল্পিত ছক করে লিজের জমি দখলকে কেন্দ্র করে ফকিরকে হত্যা করা হয়। এরপর তাকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা খুন করেছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। কিন্তু মামলার বাদী ও ভিকটিমের বাবা পিবিআইয়ের দ্বারস্থ হবেন- এমন সংবাদ পেয়ে এজাহার মিয়াকেও হত্যা করা হয়। পরে মামলা তদন্তের জন্য পিবিআই এর হাতেই আসে। এ ঘটনায় জড়িত পুরো চক্রের তথ্য আমরা পেয়েছি। সকলকে একেএকে ধরে আইনের আওতায় আনা হবে।
নিহত এজাহারের স্ত্রী ও ফকিরের মা নাছিমা বেগম জানান, থানায় গেলে পুলিশ বলত পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে বলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করত। পুলিশ আমার মেয়ের জামাই এখলাসকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। থানা পুলিশ যা পারেনি পিবিআই তা পেরেছে। আসামিরা সবাই আমাদের নিকটাত্মীয় ও পূর্বপরিচিত। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।