প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা  আরো জোরদার করতে হবে

32

চোখের পলকেই যেন দুটি বছর পার হল। প্রায় এগারো লাখ মিয়ানমারের নাগরিক, যাদের রোহিঙ্গা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়; তারা এদেশে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে স্বদেশের শাসকের লালিত সেনাবাহিনীর তাÐবের মুখে আশ্রয় নিয়েছিল। নির্যাতিত, নিপীড়িত, গৃহহারা, বাস্তুহারা, স্বামীহারা, মা হারা, বাবা হারা, সন্তানহারা এসব অসহায় মানবতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন উজাড় করে দিলেন, খুলে দিলেন সীমান্ত, আশ্রিত হলেন লাখো রোহিঙ্গা বাংলার সবুজ ছায়ায়। একজন জনদরদী মানবিক শাসক হিসাবে শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্ত পৃথিবীর তাবৎ মানুষ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছিল। তবে তার মানে এ নয় যে, প্রায় সতের কোটি মানুষের এ ছোট্ট দেশে আরো ষোল লাখ বহিঃদেশের মানুষ এ দেশে স্থায়ীভাবে থাকবে। পৃথিবীর কোন আইন তা স্বীকার করবে না। বাংলাদেশ সরকার বিগত এ দুই বছর প্রতি মুহূর্তে প্রয়াস চালিয়েছে, একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠাতে। কিন্তু নানা জটিলতায় এবং ফেরত সংক্রান্ত কার্যক্রমের ফাঁক ফোকরের কারণে দুই দুইবার সময় নির্ধারণ করার পরও রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো যায় নি। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের দিশাও মিলছে না। আমরা জানি গত ২২ আগস্ট অর্থাৎ চারদিন আগে দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসনের কথা ছিল রোহিঙ্গাদের।
তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা ফেরত কার্যক্রম শুরুর প্রচেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর এখন কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি দূর করার দিকেই নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়। এ জন্য কূটনৈতিক তৎপরতাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর আগে রোহিঙ্গাদের নিজভূমিতে প্রত্যাবাসনে গত বছর ২৩ জানুয়ারি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা আর হয়নি। উপরন্তু তহবিল সংকটে হোঁচট খাচ্ছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে উদ্বাস্তুদের সহায়তায় নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ। এ সংকট দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। মানবিক সংকট হিসেবে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে ভূরাজনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। এ সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে সোচ্চার হতে হবে। জাতিগতভাবে নিধনের উদ্দেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু গত ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে অভিযানের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে নির্মমভাবে। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা, ধর্ষণের শিকার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। সহিংসতার ঘটনায় প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকেই আরো অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা এবং মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি সংহতি এবং রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের তাগিদ জানিয়ে আসছে বিশ্ব স¤প্রদায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হয়নি। রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের পদক্ষেপের ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। অপরদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতেও আন্তরিক নয় মিয়ানমার। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাদের নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমারের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। চীন, ভারত, জাপানের মতো দেশগুলো চায় এ সংকট এ অঞ্চলের মধ্যেই সমাধান হোক। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের নাগরিক পরিচয়ের স্বীকৃতি, তাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা ও নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে বিশ্ব স¤প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। মানবিক কারণেই প্রতিবেশী মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বাড়তি দায়িত্ব বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় বোঝা। আমরা আশা করছি, দ্রæত এই সংকটের সমাধান হবে।