প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবেশ রক্ষায় ৮ প্রস্তাব

24

ওয়াসিম আহমেদ

পর্যাপ্ত জনবল ও পরিবেশ সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকটে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারকি করা সম্ভব হয় না। তাই উপজেলা পর্যায়ে জনবল কাঠামো তৈরির প্রস্তাব করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিচালক মুফিদুল আলম। গত বৃহস্পতিবার পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো এক চাহিদাপত্রে এমন তথ্য জানানো হয়।
এছাড়া প্রত্যেক জেলার মামলাসমূহ পরিচালনার জন্য নিজস্ব নিয়োগকৃত আইনজীবী প্যানেল, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি পুষিয়ে উঠার জন্য আদায়কৃত জরিমানার অর্থ দিয়ে একই এলাকায় পরিবেশ উন্নয়ন, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সার্বক্ষণিক টহল, পরিবেশের ছাড়পত্র ব্যতীত কোন প্রকল্পের বিপরীতে প্রশাসনিক অনুমোদন দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষণ থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে চালুকৃত সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার এখতিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব করা হয়।
জানা গেছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২০তম বৈঠকের আলোচনা মোতাবেক পরিবেশ অধিদপ্তরের চাহিদা নিরুপনে চিঠি দিয়েছে মহাপরিচালকের কার্যালয়। সে প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিবেশ সুরক্ষায় আটটি প্রস্তাব করে আঞ্চলিক কার্যালয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কার্যালয়টির পরিচালক মুফিদুল আলম পূর্বদেশকে জানান, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আলোচনা অনুযায়ী আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি। এসব প্রস্তাব মূলত পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে করা হয়েছে। একটি অভিযান করতে গেলেও পরিবেশকে কয়েকটি সংস্থার সহায়তা নিতে হয়। এভাবে জনবল সংকট, নূন্যতম আনুষাঙ্গিক উপকরণ ব্যতীত পরিবেশ সুরক্ষার কর্মকান্ড তদারিক করা কঠিন বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রমতে, মাঠ পর্যায়ের পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয়/অঞ্চল, মহানগর বা জেলা কার্যালয়ের জনবল কাঠামো ও প্রযোজনীয় জনবল নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে কোন জনবল কাঠামো ও জনবল নিয়োজিত নেই। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রম নিবিড়ভাবে মনিটরিং সম্ভব হয় না। জেলা পর্যায়ের জনবল দিয়ে উপজেলা বা ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে পরিবেশের সুষ্ঠু তদারকি করা কঠিন। তাই উপজেলা পর্যায়ে জনবল কাঠামো সৃজন করা প্রয়োজন। প্রত্যেক উপজেলায় সহকারী পরিচালক মর্যাদার একজন কর্মকর্তা, একজন পরিদর্শক, একজন কম্পিউটার অপারেটর ও একজন অফিস সহায়ক পদায়ন করা যেতে পারে। একই সাথে অফিসের কাজে ব্যবহারের জন্য উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মোটরসাইকেল বরাদ্দ দেওয়ার চাহিদা দেওয়া হয়। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট পরিচালনার জন্য অনেক বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল ও আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র নেই। ফলে চাহিদার নিরিখে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে কমপক্ষে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পদায়ন, ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যবহারের জন্য গাড়ি, মিনি ট্রাক, বুলডোজার, স্কেভেটার, পে-লোডার, শাবল, হাতুড়ি ইত্যাদি সরঞ্জাম সরবরাহ করা দরকার।
উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ ও তাদের অনুক‚লে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনার অংশ হিসেবে পরিবেশ আদালতে নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়। মামলা রুজু, তদন্ত, চার্জশিট প্রদান, আদালতে নিয়মিত হাজিরা, সাক্ষ্য প্রদান ইত্যাদি কাজে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ দরকার। বিদ্যমান জনবল কাঠামোতে এই কার্যক্রম সম‚হ সঠিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয় না।
এ অবস্থায়, প্রত্যেক জেলার মামলা পরিচালনার জন্য নিজস্ব নিয়োগকৃত আইনজীবী প্যানেল থাকা দরকার। পরিবেশের ক্ষতিসাধন করলে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়। কিন্তু পরিবেশের উন্নয়ন সে তুলনায় হচ্ছে না। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানা নিয়ে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোন এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হলে উক্ত এলাকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি পুষিয়ে উঠার জন্য আদায়কৃত অর্থ দিয়ে বনায়ন, চারা বিতরণ, বৃক্ষ রোপণ, পরিবেশ সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণসহ নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হলে মানুষ পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হবে। একই সাথে পরিবেশের উপর আরোপিত ক্ষতি কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
সরকারি অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সে প্রস্তাবে উদাহরণ টেনে বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত প্রকল্প এবং সমতল এলাকায় সড়ক ও জনপদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের অনেকগুলো প্রকল্প জনগুরুত্বপূর্ণ কিন্তু পরিবেশের বিবেচনায় ঝুঁকিপ‚র্ণ। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এনফোর্সমেন্ট করতে গেলে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ব্যতীত কোন প্রকল্পের বিপরীতে প্রশাসনিক অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রস্তাব করা হয়।
বঙ্গোপসাগরের তীরে ও মাঝে জাহাজ পরিদর্শন করতে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের। এটি একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল, অপরদিকে অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবলের অভাবে কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করা কঠিন। জাহাজ শিল্পে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, উপযুক্ত জনবল পদায়ন এবং এহেন ঝুঁকিপ‚র্ণ কাজের বিপরীতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনুক‚লে সম্মানি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এ কাজে স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করা যায়।
পরিবেশ সুরক্ষায় টহলদল করার প্রতি জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় টহলরত থাকেন। বর্তমানে পরিবেশ ও প্রতিবেশের অবক্ষয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চেয়েও কোন অংশে কম নয়। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সার্বক্ষণিক টহল প্রয়োজন। এজন্য প্রতি জেলায় একটি পিকআপ ভ্যান সরবরাহ ও ড্রাইভার নিয়োগ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক আনসার নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
সর্বশেষ প্রস্তাবে বলা হয়, শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত পরিবেশ ও প্রতিবেশের দূষণ করে থাকে। দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষণ থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে চালুকৃত বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। বিদ্যমান আইনে এ ক্ষমতা শুধুমাত্র মহাপরিচালকের এখতিয়ারভুক্ত। এতে দীর্ঘসূত্রিতা হয়। এটিকে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়।