প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

3

বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে বায়ু দূষণে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। কয়েকদিন আগে রাজধানী ঢাকা একদিনে বায়ু দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঢাকা এমনিতেই বায়ু দূষণের শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বেশ কয়েকটি শহর কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও এখন চট্টগ্রামে অস্বাস্থ্যকর বাযু দূষণে জনজীবন হুমকির মুখে রয়েছে। গতকাল রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামে বায়ুদূষণের মাত্রা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি পর্যবেক্ষণমূলক অনুসন্ধানি তথ্য থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, শনিবার রাত আটটায় বাতাসের মানসূচক রিয়েল টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) চট্টগ্রামের স্কোর ছিল ২৩১, যা বাতাসের মানে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত। বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র নিঃশ্বাসযোগ্য কণা (পিএম-২.৫) গ্রহণযোগ্য মান ২৪ ঘণ্টায় ১৫১ পিপিএম। চট্টগ্রামের বাতাসে তা ছিল ২৮৯ পিপিএম, যা গ্রহণযোগ্য মানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, স্কার ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়, স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু এবং স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয় আর স্কোর ৩০০ এর উপরে হলে বায়ুর মানকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। স্কোর যত বেশি হবে, বায়ুর মান তত খারাপ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আল আমিন পূর্বদেশ প্রতিবেদককে বলেছেন, একসময়ের সবুজঘেরা পাহাড়ের চট্টগ্রাম শহর এখন পাহাড়শূন্য বলা যায়। ফলে শহরের কার্বন ডাই-অক্সাইড শাষণের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। একদিকে েৈবশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বনায়ন দিন দিন কমে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাতাসের দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের গতি বেড়ে যায়। তাছাড়া যানবাহন, শিল্পকারখানা ও বর্জ্য পাড়ানো থেকে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। ফলে নির্মাণকাজ হতে সৃষ্ট ধুলাবালি আর ধোঁয়া বাতাসে মিলিত হয়ে অতিক্ষুদ্র ধুলিকণায় রূপান্তরিত হয়ে বাতাস দূষিত করে। আমরা জানি, বাযু দূষণ বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ১৯৯৮ সালের তুলনায় বাযু দূষণ ৬৩ শতাংশ বড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের ১৬ কাটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রা, প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ একজন মানুষকে সুস্থভাবে বঁচে থাকার জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের চয়ে কম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ থাকতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয় শুধু, ৬৪টি জলার মধ্যে ৫৪টি জলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের প্রধান নগর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায় ৫৮ শতাংশ, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস (ইরড়সধংং) পাড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ি। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লাক গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রাক, ১৪ ধরনের হৃদরোগ; ফুসফুস, স্তন, মূত্রথলির ক্যান্সার; সিওপিডি, হাঁপানি, ফুসফুস সংক্রমণ; চর্মরোগ, অ্যালার্জি; ৯ ধরনের চোখের অসুখ; সংক্ষিপ্ত গর্ভাবস্থা, বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত ঋতুচক্র; শিশুর জন্মকালীন রুগ্নতা ও বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া; স্নায়ু বৈকল্য, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমারস; অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ বহু রাগের সঙ্গে বায়ু দূষণের সম্পর্ক রয়েছে। বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে এ সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয়ান দেশগুলো বাযু দূষণ প্রতিেেরাধে অনেক চ্যালেঞ্জিং এবং কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে দূষণে প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক সফলতা দেখিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে চীন সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে। দশটি দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দূষণ রোধে তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করেছে। দূষণকারী শিল্পকারখানার সংখ্যা কমিয়েছে। রাস্তায় পানি ছিটানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এতে দশটির বায়ুর মান ৪২ শতাংশে বেশি উন্নতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ৬৫ শতাংশ উন্নতি করেছে। বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা এক বছর চার মাস বেশি বাঁচে। এর কারণ দেশটি নির্মল বায়ু আইন করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশ এ ক্ষেত্রে চরম উদাসিন মনে হয়। এ ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রণয়ন ও স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থাপনায় এর বাস্তবায়নসহ নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে পারলে দেশের মানুষ অস্বাস্থ্যকর বাযু থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
প্রকৃতপক্ষে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মানবসৃষ্ট উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।