প্রতিবন্ধিতা জয়ী এক দুর্দান্ত সাইক্লিস্ট তরুণের গল্প

10

পূর্বদেশ ডেস্ক

প্রতিবন্ধী শব্দটি শুনলেই চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে একজন মানুষের শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতার গল্প। কিন্তু কেউ কেউ সেই সীমাবদ্ধতার গন্ডি পেরিয়ে এগিয়ে গেছেন বহু দূর। ফটিকছড়ির তাহমিদ আহমেদ চৌধুরী তাদেরই একজন। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এই তরুণ সীমাবদ্ধতার সব সূত্রকে মিথ্যা প্রমাণ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমস ডাউন হিল বাইকিংয়ে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।
তাহমিদের স্বপ্নের এখানেই শেষ নয়। ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের মতো পেশাদার খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান বাইকিংকে। এ খেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সুনাম বয়ে আনতে চান দেশের জন্য। খবর বাংলানিউজের
তাহমিদ ফটিকছড়ির ভ‚জপুর থানার দাঁতমারা নিচিন্তা এলাকার আহমেদ আবু রাহাত চৌধুরী ও নুরুন্নেচ্ছা বেগম দম্পতির বড় ছেলে। জন্মগতভাবে বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী এই তরুণের জন্ম ২০০০ সালে। তাহমিদ খেলাধুলার পাশাপাশি পড়ালেখা করেছেন নগরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
জন্মের এক বছরের মাথায় তাহমিদের বাক ও শ্রবণ সমস্যার বিষয়টি বুঝতে পারে পরিবার। এরপর চট্টগ্রাম-ঢাকার চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন স্বজনেরা। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও স্বাভাবিক হয়নি কথা বলা। ছোটবেলা থেকে তাই কথা বলতে ও শুনতে না পারা তাহমিদকে মুখোমুখি হতে হয়েছে শত প্রতিবন্ধকতা।
এতো এতো ঝামেলার মধ্যেও ব্রেইলে লেখা বই না পড়ে সাধারণ বই নিয়ে পড়ালেখা করেছিলেন তাহমিদ। ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০১৮ সালে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় পড়ালেখা। এরপর তাহমিদ সাইকেল চালানোয় মনোনিবেশ করেন। যদিও সাইকেলের সঙ্গে তার পরিচয় শৈশবেই।
সময়টা ২০১২ সাল। তাহমিদ ১২ বছরের বালক। একদিন ফেসবুক ও ইউটিউবে মাউন্টেন বাইকিং ভিডিও দেখে আগ্রহ জন্মে এই খেলার প্রতি। সেই থেকে মাউন্টেন বাইকিং নিয়ে রেকর্ড গড়ার নেশা তাহমিদের মাথায় এসে চাপে। তারপর নানার কাছে বায়না ধরলেন তারও একটি সাইকেল চাই। নিরাশ করেননি নানা। নাতিকে সাইকেল কিনে দেন। ২০১৬ সালের দিকে সেই সাইকেল নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় রাইড দেওয়া শুরু করেন, যুক্ত হন একটি সাইক্লিং কমিউনিটি গ্রুপে। এভাবেই সাইক্লিং জগতে প্রবেশ তাহমিদের।
মায়ের মুখে সাহসের নানা গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন আরও বেশি। এমটিবি সাইকেল নিয়ে দলের সদস্যদের সঙ্গে সাইক্লিংয়ের চর্চা শুরু করেন। ধীরে ধীরে কসরতের প্রাথমিক দক্ষতাগুলো তার আয়ত্বে চলে আসে। সুযোগ হলেই সবার সামনে প্রদর্শন করতেন সেসব কসরত।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে ফটিকছড়ির হাজারীখীলের একটি পাহাড়ে আয়োজিত এমটিবি অ্যান্ডুরো রেসে অংশ নেন। সেখানে ৪০ জন প্রতিযোগির মধ্যে তাহমিদ তৃতীয় হন। এটিই তার প্রথম অর্জন। এই অর্জন চোখ খুলে দেয় তাহমিদের। পরবর্তী কয়েকটি রেস ইভেন্টে ধারাবাহিকভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে থাকেন। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্যটা ধরা দেয় ২০১৯ সালে। সে বছর নেপালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ডাউন হিলে অংশগ্রহণ করেন তাহমিদ। অসুস্থতা নিয়ে অংশগ্রহণ করেও অষ্টম হন তিনি। এরপর এমটিবি বাংলাদেশ অ্যান্ডুরো চ্যাম্পিয়শিপে প্রথম হয়েছিলেন তাহমিদ।
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ‘মাউন্টেন বাইকিংয়ে প্রতিযোগিদের একটি পাহাড়ি বা অসমতল রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যেতে হয়। এমন কঠিন সাইক্লিংয়ে কৃতিত্ব দেখানো কঠিন’। সেক্ষেত্রে তাহমিদের অর্জনটাকে বড় চোখেই দেখতে হয়।
মাউন্টেন বাইকিং সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে প্রায় ৫শ এর অধিক সাইক্লিস্ট মাউন্টেন বাইকিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাদের অধিকাংশই তরুণ এবং উদ্যমী। এসব তরুণ মাউন্টেন বাইকারদের উদ্দেশ্য হলো, এই দেশে মাউন্টেন বাইকিং খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলা।
সম্প্রতি সাইক্লিংয়ের নানা কসরত দেখিয়ে তাহমিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ছোটবেলা থেকেই সাইক্লিংয়ের প্রতি ভালোলাগা। সাইক্লিং করা ছিল আমার প্রথম শখ। ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের সাইক্লিং রোড স্টান্ট গ্রুপ আরএসআর জেড টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাইক্লিংয়ের প্রাথমিক ধাপ শুরু করি। ২০১৮ সালে একদল সাইক্লিস্টকে পাহাড়ে সাইকেল চালাতে দেখে প্রেরণা পাই। তখন থেকে পাহাড়ে সাইকেল চালানোর উৎসাহ আমার মধ্যেও জাগে। নেপালের পেশাদার মাউন্টেন বাইকার রাজেশ মাগার ও দেশের অন্যতম মাউন্টেন বাইকার প্রয়াত তারেকুর রহমানকে দেখে মাউন্টেইন বাইকিংয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
তাহমিদ আরও বলেন, আমার স্বপ্ন মাউন্টেন বাইকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। উদীয়মান রাইডারদের উৎসাহ দিয়ে সম্মিলিতভাবে দেশে এই মাউন্টেইন বাইকিংকে। একটি পেশাদার স্পোর্টসে রূপ দিতে চাই। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন।
তাহমিদের মা নুরুন্নেচ্ছা বেগম বলেন, সমাজে প্রতিবন্ধী সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা বদলাতে হবে। মেধা ও যোগ্যতা প্রকাশেরও সুযোগ দিলে প্রতিবন্ধীরা ভালো ফলাফল করে। তাদের জন্য অনন্য উদাহরণ তাহমিদ। সে সবকিছু আমার চেয়ে আরও ভালোভাবে করতে পারে। মোবাইল ও ল্যাপটপের সব কাজ ভালোভাবে বুঝতে পারে। ছেলেকে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে সে প্রতি ক্লাসে ১ম-৩য় স্থানে থাকতো। স্কুলের খেলায় সবসময় ভালো করতো। ছেলে মাউন্টেন বাইকিং নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তাকে সে সুযোগ দিয়েছি। সে দেশের হয়ে সাফ গেমসে অংশগ্রহণ করেছিল। আশা করি সামনে আরও ভাল করবে।