প্রতিদিন গড়ে তিনশ টন ইলিশ বেচাকেনা

20

তুষার দেব

নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর গভীর সাগরে মাছ আহরণ শেষে ট্রলার নিয়ে প্রতিদিন ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। টানা দু’মাসেরও বেশি সময়ের সুনশান নীরবতা ভেঙে জেলেদের হাঁকডাকে এখন সরগরম নগরীর বৃহত্তম পাইকারি মৎস্য বাজার ফিশারিঘাট। সুস্বাদু রূপালী ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুমের শুরুতেই জালে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের ইলিশ মাছ উঠছে। তাতে জেলেদের মুখে খুশির ঝিলিক। আড়তদাররা বলছেন, গত দুই-তিনদিন ধরে ফিশারিঘাটে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিনশ’ টন ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে। তাতে মাছের আড়তে শুধু ইলিশের হাতবদলে প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা।
প্রজনন মৌসুমে টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ২৩ জুলাই মধ্যরাত থেকে মাছ আহরণে ট্রলার নিয়ে সাগরযাত্রা শুরু করেন জেলেরা। এরপর থেকে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ ধরা পড়ার খবর আসতে থাকে। আহরিত মাছ নিয়ে এখন ঘাটে ট্রলারের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। ট্রলার থেকে মাছ খালাস করার সময় পরিলক্ষিত হচ্ছে রূপালী ইলিশের আধিক্য। সামুদ্রিক মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় এবার আকারে বড় বড় ও পরিমাণে বেশি ইলিশ ধরা পড়ার কথা জানালেও খুচরা বাজারে দাম এখনও আকাশছোঁয়া। তবে আবহাওয়া ঠিক থাকলে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়বে বলে জেলেরা মনে করছেন। বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়ার সাথে সাথে দামও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
ফিশারিঘাটের আড়তদাররাও বলছেন, দু’মাসেরও বেশি সময়ের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ট্রলার ও জাল নিয়ে সাগরে মাছ আহরণে গেছেন হাজার হাজার জেলে। গভীর সাগর থেকে গত দুই তিনদিন ধরে জেলেরা প্রচুর পরিমাণে রূপালী ইলিশ ধরে আনছে। ফিশারিঘাটের পাইকারি মৎস্য আড়তে বর্তমানে পাঁচশ’ থেকে সাতশ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ মণপ্রতি ১৭-১৮ হাজার টাকা এবং আটশ’ গ্রাম থেকে ১২শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৩ হাজার টাকায়। আর এক কেজি থেকে দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৫২-৫৫ হাজার টাকায়।
নতুন ফিশারিঘাটে পাইকারি মৎস্য বাজারের আড়তদার ও সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে মাছ আহরণ শুরু হওয়ার পর গত দুই-তিন দিন ধরে বাজারে প্রতিদিন গড়ে দুইশ’ থেকে তিনশ’ টন ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে। শুধু ইলিশ বেচাকেনা খাতে প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে দশ থেকে ১২ কোটি টাকা। প্রজনন মৌসুম শেষে ইলিশ আহরণে আরও কমপক্ষে দুই মাস সাগরে ইলিশ ধরতে পারবেন জেলেরা। সেই হিসেবে এবার প্রতি মাসে অন্তত তিনশ’ কোটি টাকার ইলিশ বেচাকেনা হবে বলে আশা করা যায়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত ২৭ হাজার ২৩ জন জেলে রয়েছেন। প্রজনন মৌসুমে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় তারা সাগরে মাছ ধরতে নামেননি। এতে সাগরে ইলিশ মাছ আকারে বড় হওয়ার অনুক‚ল পরিবেশ পেয়েছে। ছোট আকারের ইলিশ বা জাটকা ধরা বন্ধ থাকায় নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরপরই সাগরে বিভিন্ন আকারের ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ ধরা পড়ছে। আশা করছি, এই অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে ছয় লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এক দশকের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৪ শতাংশ। চলতি মৌসুমে তা ছয় লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের জলসীমার প্রায় সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। ক্রমবর্ধমান ইলিশ উৎপাদনের এই প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে ইলিশ উৎপাদনেও বাংলাদেশ রয়েছে প্রথম স্থানে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার জাটকা নিধন রোধে বিগত ২০০৬ সাল থেকে দেশের অভয়াশ্রমগুলোতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কার্যক্রম শুরু করে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতিবছর পয়লা নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আট মাস জাটকা (১০ ইঞ্চির চেয়ে ছোট ইলিশ) আহরণ, পরিবহন ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে। গতবছর প্রথমবারের মত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের জন্য বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। আগে এই নিষেধাজ্ঞা কেবল আড়াই শতাধিক বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলারের জন্য বলবৎ থাকলেও গতবছর থেকে সাগরে মাছ আহরণের জন্য ব্যবহৃত যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক সব ধরনের নৌযানকেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়।
উল্লেখ্য, সরকারি হিসেবে আগে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাগরে ইলিশ আহরণের মৌসুম ধরা হলেও এখন প্রজনন মৌসুম বাদ দিয়ে পরবর্তী তিনমাসও ইলিশ আহরণের মৌসুম হিসেবে গণনা করা হয়। মা ইলিশের ডিম ছাড়ার কারণে আশ্বিনী পূর্ণিমায় (অক্টোবর) ভরা মৌসুমে সরকার দেশের সমুদ্র উপকূলে নদী ও নদীর মোহনায় ইলিশ আহরণে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শুরুতে এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ১১ দিন থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২২ দিন করা হয়। এতে ইলিশের আকার, ওজন এবং আহরণের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বর্তমানে সাগর থেকে আহরিত ইলিশের বাজারমূল্য ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।