প্রতারণার ঘূর্ণিপাকে ই-কমার্স ও এমএলএম

52

 

ঘরে বা অফিসে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে ব্যবসা করা হয় তাকে এক কথায় ই-কমার্স বা Electronic Commerce বলে। অনেকের মতে, আধুনিক, ডিজিটাল পদ্ধতিতে যে ব্যবসা করা হয় তারই নাম ই- কমার্স।কেননা এ ব্যবসার সকল কার্যক্রম ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ঘরে বসেই যে কেউ,যে কোন পণ্যের মান,পণ্যের দাম সম্পকে অবগত হতে পারে এবং ওয়েব সাইটের মাধ্যমে পণ্য অর্ডার সহ ক্রয়ে, বিক্রয় করতে পারে। ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড এইক্ষেত্রে অনেকে ব্যবহার করে থাকে। সহজ ভাষায় ই-কমার্স ব্যবসা হল অনলাইন ভিত্তিক একটি মার্কেটপ্লেস যেখানে নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট বা অনলাইন স্টোর থাকে এবং গ্রাহকরা অনলাইনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় পন্য অর্ডার করতে পারে।
ওয়েবসাইট ওনার বা মালিক অর্ডারকৃত পণ্য কাস্টমারের কাছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেয়।অন্যদিকে বহুস্তর বিপণন ব্যবসায়িক যে পদ্ধতি তা হচ্ছে বিতর্কিত এমএলএম। এই এমএলএম মুলত উদ্ভব হয় ১৯২০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভিটামিন কোম্পানি নামক এক সংস্থা হতে। তারা প্রথমে লক্ষ্য করে,তাদের পণ্য তাদের ডিস্ট্রিবিউটরদের চেয়ে রেফারেন্স এর মাধ্যমে বেশি বিক্রি হয়। রেফারেন্স হচ্ছে মুলত এক খরিদ্দার আরেক এক খরিদ্দারকে পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করে, তারা ও পণ্য ক্রয় করে। কোম্পানি তখন বিষয়টি নজরে নেয় এবং ডিস্ট্রিবিউটরদেরকে হটিয়ে দিয়ে তাদের নির্ধারিত সিস্টেমের মধ্যে এক খরিদ্দার আরেক খরিদ্দারের নিকট পণ্য বিক্রি করলে কোম্পানি কমিশন দেবে বলে ঘোষণা দেয় এবং কমিশন দিয়ে ও কোম্পানি লক্ষ্য করে তারা দিন দিন লাভবান হচ্ছে। মুলত তারা এই পদ্ধতি অনুসরণ করে পরবর্তীতে তাদেরকে অনুসরন করে অনেকে এই ধরনের ব্যবসা শুরু করেন আর তখন থেকে এমএলএম ব্যবসা মুলত শুরু। শুরুর প্রথম থেকে বিভিন্ন ফাঁকফোকরে শুরু হয় গ্রাহক প্রতারণা ও ভিন্ন ভিন্ন কায়দা গ্রাহকদের সাথে এমএলএম কোম্পানির ও তাদের নির্ধারিত লোকদের চলচাতুরী।
বাংলাদেশে ১৯৯০ সাল থেকে ৯৮ সাল পর্যন্ত তেমন কোন এমএলএম কোম্পানির নাম শুনা না গেলে ও সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে জিজিএন নামক এমএলএম কোম্পানিটি সকলের নজর কাড়ে। বিশেষ করে যুব সমাজ সহ সর্বস্তরের মানুষ জিজিএন সহ পরবর্তীতে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার ফাঁদে পা ফেলে। ডাক্তার, উকিল, ছাত্র-ছাত্রী যুবক যুবতী, গৃহিণীরা ও অতি সহজে গাড়ি বাড়ি করার স্বপ্ন বা স্বাদ পূরণে মরিয়া হয়ে উঠে, ধনী হওয়ার একমাত্র সহজ রাস্তা ভেবে এই এমএলএমে তারা কাজ শুরু করে।কোম্পানি দেশের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবককে ধনী হওয়ার একমাত্র পথ জানান দিয়ে গ্রাহকদের সরলতাকে পুঁজি করে বিশেষ করে যুব সমাজকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ কোটি মানুষকে নিঃস্ব করে পথে বসিয়ে দেয়।
বিশ্বব্যাপী আলোচিত পণ্য বিপণন এই (এমএলএম) ব্যবস্থায় কিছু অসাধু চক্র প্রতারক, সহজ সরল মানুষকে নানান ধরনের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে কোম্পানি ও কোম্পানির ঘনিষ্ঠ নিজস্ব কিছু লোকজন কোটি কোটি বিদেশে পাচার করে আবার কেউ কেউ অনৈতিক ভাবে উপার্জিত টাকা নিয়ে বর্তমানে দেশে আবার কেউ বিদেশে বহালতবিয়তে আছে।
এমএলএম পদ্ধতিতে কেউ ব্যবসা করলে আইনত দÐনীয় হবেন। সাধারণ মানুষ এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে নিশ্চিতভাবেই তাঁরা ঠকবেন এবং কোনো প্রতিকার ও পাবেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান সমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আরও জানা গেছে,গ্রাহক হতে সংগৃহীত ডেসটিনির পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা।গ্রাহকের অর্থে নিজেদের নামে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। তাহা ছাড়া এমএক্সএন,মডার্ন হারবাল ফুড, ওয়ার্ল্ডভিশন ২১, স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড ও রিচ বিজনেস সিস্টেম এদেরকে সরকার একসময় লাইসেন্স দিলেও পরবর্তীতে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়।
অন্যদিকে এমওয়ে ইন্টারন্যাশনাল,টিয়ানসি বিডি,এস এম এন গেøাবাল, এবি নিউট্রিক ইন্টারন্যাশনাল, অ্যাড ভান্স বাংলা,ডি ক্ল্যাসিক লাইফ বিডি, ড্রিম টুগেদার একসিলেন্ট ফিউচার মার্কেটিং, ফরেভার লিভিং প্রডাক্টস বিডি, পিনাসেল সোর্সিং,সানুস লাইফ বিডি, লাইফওয়ে বিডি,লাক্সার গেøাবাল এন, ম্যাকনম, ইন্টার ন্যাশনাল এবং ভিশন ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি লিমিটেডের মধ্যে অনেকে আবার ভিন্ন ভিন্ন নামে সরকারি নজরদারি না থাকার কারণে সাইন বোর্ড না লাগিয়ে অফিস ভাড়া করে গোপনে বা প্রকাশ্যে এম এলএমের আড়ালে ই- কমার্স নামে অবৈধভাবে ব্যবসা করছে।
আমরা জানি, আমাদের দেশের মানুষরা ভুলোমনা চরিত্র, অত্যধিক লোভপ্রবণতা তাদের মধ্যে সব সময় কাজ করে,তাদের দুর্নীতিপরায়ণ মনোভাবও আরাম আয়েশি চিন্তা, চেতনা এমনকি অতি সহজে কোটিপতি হওয়ার ভাবনা বা স্বপ্ন মুল সমস্যার কারন।
অন্যদিকে সবাই জানে,দেশে বিচারহীন সংস্কৃতি বিরাজ করছে তা জেনে অপরাধী যারা তারা নিশ্চিন্তে অপরাধ কর্ম চালিয়ে যায়। অন্যদিকে বিভিন্ন আইনি জটিলতা তাদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনাও সম্ভব হয় না। এমএলএম সহ ই-কর্মাস ব্যবসার নীতিমালা ও সরকারের কঠোর নজর দারির না থাকায় এদেরকে বিচারের আওতায় আনা বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে দেশের বানিজ্যমন্ত্রীকে ও ই-কমার্স ব্যবসায় প্রতারিত হতে হয় শুধু তাই নয় বর্তমানে এমএলএমের মত ই-কর্মাস ব্যবসায় সাধারণ গ্রাহকরা অহরহ প্রতারিত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার অনেক গুন বেড়েছে।অ্যামাজান, আলিবাবার মত ২/৪টি ই-কর্মাস ব্যবসার উদাহরণ টেনে দেশিয় অনেক কোম্পানি এম এলএমের আড়ালে তারা ই-কমার্স ব্যবসা করছে।এই সব ভুঁইফোঁড় কোম্পানি দ্বারা অনেকে প্রতারিত হচ্ছে এবং এমএলএমের মত ই-কমার্স ব্যবসা হতে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে ই- কমার্স ব্যবসায় প্রতারনার আরেক নাম ইভ্যালি।২০১৮ সালে মাত্র ৫০০০০/ টাকা পরিশোধিত মুলধন নিয়ে তারা ব্যবসা শুরু করলেও এখন তাদের নিকট গ্রাহকের পাওনা মাত্র ৯৫০ কোটি টাকা। অনেকে ইভ্যালি হতে স্বলমুল্যে পন্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করবে এই আশায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। কোম্পানি মিডিয়াতে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও রাষ্ট্রীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের গ্রহন যোগ্যতা অর্জন করে পরবর্তীতে সেই সুযোগে তারা প্রতারনার আশ্রয় গ্রহন করে। ১৯৯৮ সালে এমএলএম এরপর ২০১৫ সালে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু হলেও সরকারের আগাম কোন ব্যবস্থা বা নীতি মালা না থাকায় জনগন বারবার প্রতারিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে কিছু নীতিমালা গৃহীত হলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়া এই ধরনের প্রতারনা বারবার হচ্ছে বলে সবাই মনে করেন। মাঝে মাঝে বানিজ্যমন্ত্রনালয় লোক দেখানো নীতিমালা করলে ও তা অজানা কারণে বাস্তবায়ন না হওয়াভুক্তভোগীরা সরকারকে দায়ী করছে। ইতিমধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় কর্তৃক এসক্রো সার্ভিস চালুর যে কথা বলা হয়েছে তাতে টাকা প্রথমত বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিকট যাবেনা ও ৭ দিনের মধ্যে পন্য সরবরাহ করা না হলে বা মান সম্মত না দিলে পন্য ফেরত ও টাকা সংগৃহীত প্রতিষ্ঠানটি ফেরত দিবে। এটি তেমন কার্যকর হবে বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছেন না। তাছাড়া দেশি, বিদেশি কিছু প্রতারকচক্র বিশেষ করে মালেশিয়া, ভারত, শ্রীলংকা তারা দেশিয় কিছু অসাধু চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে নিত্য নতুন সফটওয়ার তৈরি করে মানুষকে প্রতারনা করছে। কেউ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে আবার অনেকে সমবায় অফিস থেকে মাল্টিপারপাস কোম্পানি করার জন্য একটি রেজিঃ নম্বর নিয়ে মানুষকে লাভের প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে।
এই ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর (জনপ্রতি) টাকার পরিমান কম হওয়া সবাই লজ্জায় প্রতিকার পাবেনা ভেবে থানায় বা আদালতকে অবহিত করে না। বর্তমানে এমএলএমের মত ই- কমার্স ব্যবসা অহরহ যে প্রতারনা হচ্ছে তা কোন সাধারণ মানুষের কাম্য নয়। তাই ডেসটিনি, নিউওয়ে, যুবক, ইউনিপে টু ইউ সহ সকল এমএলএম, ই-কমার্স হতে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এমন সব কোম্পানি দুদকের মাধ্যমে তা যেন তদন্ত করা হয় এবং যারা টাকা আত্মসাৎ বা চক্রান্ত কারী তাদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয় ও প্রতারনা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপসহ অতি দ্রুত সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও সঠিক বাস্তবায়ন অতি জরুরি বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী