প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সকলের নিকট থেকে সহনশীল আচরণ প্রত্যাশা

13

রতন কুমার তুরী

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সকল ব্যক্তিরা জনগণের সেবা করার মাধ্যমে জনগণের মন যোগাবেন এবং দেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখবেন এটাই তাদের কাছে জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু তারা যখন সেবকের বদলে নিজেদের প্রভু মনে করে জনগণকে অবমূল্যায়ন করেন ঠিক তখনই দেখা দেয় বিপত্তি।
বেশকিছু দিন ধরেই দেশের প্রশাসন ক্যাডারদের নামে তাদের ‘স্যার’ সম্বোধন করে কথা না বলার জন্য বিভিন্ন সেবাপ্রার্থিদের হয়রানি কিংবা হেনেস্থা করার বিষয়টি লক্ষ করা যাচ্ছে। এই বিষয়টি যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্যবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। সর্বশেষ প্রশাসনের একজন বড় কর্মকর্তা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে স্যার ডাকা নিয়ে যা করলেন তা সত্যিই নিন্দনীয়। অবশ্য ইতিমধ্যে ব্যাপারটি তিনি মিটিয়ে নিয়েছেন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় এই মানসিকতা কেনো ? দেশের সবধরনের জনগণ বিভিন্ন কাজে তাদের কাছে যাবে এবং সেবা চাইবে তাই বলে তাদেরকে স্যার ডাকতে হবে নাহলে তারা সেবাপ্রার্থিদের অপমান করবে, অফিস থেকে বের করে দেবে,ক্ষমতার দম্ভ দেখাবে এটা সত্যিই দুঃখজনক। এমন দুঃখজনক এবং অন্যায় পন্থা থেকে তাদের দ্রæত বের হয়ে আসা উচিত। কারণ দেশের মানুষ সেই ব্রিটিশ আমলে পড়ে নেই দেশ এগিয়েছে অনেক দূর সাথেসাথে মানুষও শিক্ষিত হচ্ছে তারা বুঝতে শিখছে ন্যায় অন্যায়, এবং তারা এও বুঝতে শিখছে দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় চলা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত সকলের কাজই হচ্ছে জনগণের সেবা করা, তাদেরকে স্যার সম্বোধন করা কোনো অবস্থাতেই বাধ্যতামূলক নয়। ফলে এই উপলব্ধি থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ হচ্ছে এবং সেই প্রতিবাদে অনেক মানুষ অংশগ্রহণ করছে। তারা সকলেই এই এমন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার অবসান চায়। মূলতঃ ব্রিটিশরা এ দেশে আমলাতন্ত্রের ভিত গাড়ার আগে এ দেশে প্রশাসন ছিল। তখন পদের নামেই সম্বোধন চলত। রাজা, কাজি, আমিন, তালুকদার, জায়গিরদারদের পদ বা কখনো কখনো বাদশার কাছ থেকে পাওয়া উপাধি বা পদবি দিয়েও সম্বোধন চলত। ব্রিটিশরা নিজের দেশে নাম বা পদ ধরে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু রাখলেও উপনিবেশের বাসিন্দাদের প্রভু মানে ‘স্যার’ সম্বোধন শিখিয়েছেন। আইসিএস কর্মকর্তা অশোক মিত্র ছিলেন ভারতের প্রথম জনগণনা কমিশনার। সমাজবিজ্ঞানী, গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিল্প ঐতিহাসিক ও শিল্প সমালোচক হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। তিনি বিলেতের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তাঁর সিনিয়র ‘ব্রিটিশ বস’ বা বড়কর্তাকে সালাম দিতে গিয়েছিলেন। অশোক মিত্র, স্যার না বলে তাঁর পদ ধরে সম্বোধন করেছিলেন। এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অশোক মিত্র লিখেছেন, ‘খেয়াল করলাম, তাঁর ভ্রুটা একটু কুঁচকে গেল যেন। তিনি নেটিভ ভারতীয়র কাছে একজন ব্রিটিশ প্রভু হিসেবে ‘ইউর অনার’ বা সম্মানসূচক সম্বোধন আশা করেছিলেন।’
ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু তাদের কুঁচকানো ভুরুটা রয়ে গেছে। কালে কালে ‘স্যারের’ শিকড়টা এমন গভীরে চলে গেছে যে এখন বড় কর্তার সব কথার উত্তর ‘স্যার’ শব্দ দিয়েই দেওয়া যায়। হ্যাঁ বাচক, না বাচক যাই হোক এক ‘স্যার’ দিয়ে সেরে ফেলা যায় কথোপকথন।
অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলা মানুষের মধ্যে পোশাকি আড়ম্বরের প্রতি একটা ঝোঁক থাকে। যে শিক্ষক ভালো পড়াতে পারেন না, ক্লাসকে আকর্ষণীয় করতে পারেন না, তিনি মারপিট, বকাবকি, হুমকি দিয়ে ক্লাস শান্ত রাখার নিষ্ফল চেষ্টা করেন। কোন ছাত্র কতটা ঝুঁকে সালাম দিল, আর কে দিল না, সেটাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান বিবেচ্য বিষয়। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল যেমন বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেই দুর্বল মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়।’
বিশেজ্ঞরা মনে করেন, প্রশাসনের ভেতরে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনদের মধ্যে প্রভু ও দাস মার্কা সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেওয়া ঠিক নয়। অর্থাৎ প্রশাসনের ভেতরেই একে অপরের প্রতি আচরণবিধিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আনা দরকার।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি আচরণ বিধিমালা আছে। প্রায় ৪০ বছর আগের এই আচরণবিধি অবশ্য ২০০২ সালে ও ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি নির্দেশনা থাকলেও নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই।
অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে, এমনটি লেখা আছে। সেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে, অসংগত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে। তবে এসবের বিস্তারিত আলোচনা সেখানে নেই।
ভুলে গেলে চলবে না সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। তাই জনগণকে ‘স্যার’ সম্বোধনে বাধ্য করার বিষয়টি কতটা ন্যায্য, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
প্রকৃতপক্ষে এঅবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত সকল ব্যক্তির বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সময়সীমা আরো বাড়াতে হবে এবং এই প্রশিক্ষণেই জনগণের সাথে তাদের আচরণ কেমন হবে তা হাতে কলমে শেখাতে হবে। যেহেতু তাদের কাজই হবে জনগণের সেবা দেয়া ফলে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণটিতে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।
আমরা প্রত্যাশা করবো প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত সকল মানুষের সাথে যুহযুগ ধরে যে বিভেদের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে তা একদিন কেটে যাবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক