পোশাকশিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা

40

ফারুক আবদুল্লাহ

ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কারখানা বন্ধ রাখা হলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তৈরি পোশাকশিল্প খাত। এর ফলে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আদেশ বাতিল ও স্থগিত হবে। নতুন অর্ডার পেতে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এছাড়া সময়মত পণ্য চালান খালাস ও রপ্তানি করতে না পারলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ও কন্টেইনার জটের সৃষ্টি হয়ে ব্যাহত হবে আমদানি-রপ্তানি। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই করোনা সংক্রমণ রোধে দুই সপ্তাহ শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্তকে অপরিকল্পিত ও আত্মঘাতি বলে দাবি করেছেন পোশাক খাতের মালিকরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরে দৈনিক গড়ে ৪৫ হাজার টিইউইউস আমদানি পণ্য চালানের কন্টেইনার জাহাজ থেকে খালাস করা হয় এবং গড়ে ৪৩ হাজার টিইউইউস রপ্তানি চালানের কন্টেইনার জাহাজীকরণ করা হয়। আমদানি পণ্য চালানসমূহ ডেলিভারি নেওয়া সম্ভব না হলে ১৪ দিনে ৬৩ হাজার টিইউইউস কন্টেইনার বন্দর জেটিতে মারাত্মক জটের সৃষ্টি করবে। বর্তমানে বন্দর জেটিতে কন্টেইনার রাখার ধারণ ক্ষমতা ৪৯,০১৮ টিইউইউস।
পোশাকশিল্প খাতের উদ্যোক্তরা জানান, গত ২০ সালের মার্চ থেকে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের গন্তব্য দেশসমূহের প্রায় সবগুলোতেই আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ লকডাউনে থাকায় একে একে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হতে থাকে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গত বছরের মার্চ মাস থেকে প্রথম লকডাউনের মধ্যে পোশাকশিল্প কারখানা ২৬ দিন বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে প্রায় ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। পোশাকশিল্পের মালিকরা শিল্পের ভবিষ্যত ও শ্রমিকদের মজুরী প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে গভীর সংকটে পতিত হলে সরকার সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে। যার ফলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হয়। পরবর্তীতে সরকার রপ্তানি বাণিজ্যের বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে পোশাক কারখানা খোলা রাখার অনুমতি প্রদান করে। এতে পোশাকখাত রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়।
বিজিএমইএ নেতারা বলছেন,২০২০-২০২১ অর্থবছরে বিগত অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানিতে প্রায় ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের রপ্তানি আদেশ বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বর্তমানে নতুন নতুন ক্রয়াদেশ উপস্থাপন হচ্ছে। এসব রপ্তানি আদেশসমূহ বাস্তবায়নে পোশাকশিল্প মালিকরা পরিকল্পনার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর প্রেক্ষিতে ঈদের পর ১৪ দিন সরকার ঘোষিত লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানাসমূহ বন্ধ রাখা হলে চলমান রপ্তানি আদেশসমূহ ক্রেতার নির্ধারিত লীড টাইমের মধ্যে জাহাজীকরণ করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে আমেরিকা ও ইউরোপে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পোশাক বিক্রি বেড়েছে। ফলে যেকোন মূল্যে দ্রæত পণ্য ডেলিভারি দিতে হবে। যেহেতু বর্তমান সময়টা ইউরোপ এবং আমেরিকাতে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচুর রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। এ সময়ে কারখানা বন্ধ রেখে চলমান রপ্তানি আদেশসমূহ সঠিক সময়ে জাহাজীকরণ করতে না পারলে ভবিষ্যতের অর্ডার গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
তারা আরও বলছেন, রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশসমূহ যথাক্রমে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, চীন ও মিয়ানমারে কারখানা খোলা রেখে উৎপাদন পরিচালনা করছে। ফলে ক্রেতার নতুন রপ্তানি আদেশ এসব দেশে স্থানান্তরে সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ঈদের পর ১৪ দিন লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য চালান ডেলিভারি নেওয়া সম্ভব হবে না, বন্দরে কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত হয়ে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে বহিঃনোঙ্গরে জাহাজের অবস্থান বৃদ্ধি পেয়ে কন্টেইনার ও জাহাজ জটের সৃষ্টি হবে। এতে বিদেশী ক্রেতাদের নিকট বাংলাদেশের ভাবমুর্তি চরম ভাবে ক্ষুণœ হবে। এছাড়াও সময়মত পণ্য চালান খালাস ও রপ্তানি করতে না পারার কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স তুলনামূলকভাবে কম এবং নিয়মিতভাবে পরিশ্রমী হওয়ার কারণে ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ) ক্ষমতা বেশি থাকায় এবং পোশাক কারখানাসমূহে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন করে কার্যক্রম পরিচালনা করায় করোনা সংক্রমণের হার অনেকটাই কম। তাছাড়া কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ শ্রমিক যার মধ্যে ৫০ শতাংশ শ্রমিক উত্তরবঙ্গের অধিবাসী। সকলেই গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে (বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে) সংক্রমণের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পরবর্তীতে শহরের কারখানাসমূহেও সংক্রমণের হার মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা রয়েছে। আর গত ঈদের সময় সরকারের সীমিত ছুটি প্রদানের সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে শ্রমিক-কর্মচারীরা অধিকাংশই নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ফলে যাতায়াত সীমিত থাকায় করোনা সংক্রমণ প্রকট হয়নি। তাই এসব বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বিপর্যয় এড়ানোর লক্ষ্যে জীবন-জীবিকার স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা খোলা রাখার নির্দেশনা প্রদান করা প্রয়োজন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সচিবালয়ে পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করে। এ সময় কারখানা খোলা রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি দেয় প্রতিনিধিদল। বৈঠকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সিদ্দিকুর রহমান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি দিয়েছি সেখানে ঈদের পর কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কারখানা খোলা রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। সচিব আমাদের আশ্বস্ত করছেন। এ ছাড়া আগামী শনিবার সরকারের একটি বৈঠক রয়েছে, সেখানে ঈদের পর কঠোর লকডাউনে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু থাকবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।