পৈশাচিকতার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাচ্ছে না

23

তুষার দেব

সময়ের ব্যবধানটা মাত্র ছয় মাসের। এর মধ্যেই শিশুকন্যা সুরমা আক্তার থেকে শুরু করে আলীনা ইসলাম আয়াত ও মারজান হক বর্ষা হয়ে বড়দের পৈশাচিকতার নির্মম শিকারের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হওয়া হতভাগীর নামটি হল আবিদা সুলতানা আয়নী। এদের প্রত্যেকের বয়স ছয় থেকে দশের মধ্যে। নরপশুর লালসা তাদের বাঁচতে দেয় নি। অকালেই নিভিয়ে দিয়েছে জীবন প্রদীপ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীতে বিগত ছয় মাসের ব্যবধানে এই চার শিশুকন্যার ওপর পৈশাচিক বর্বরতার খবর সবশ্রেণীর মানুষের মনে রেখাপাত করেছে। তাদের প্রত্যেককে হত্যার ধরন বা কায়দা যেমন প্রায় একই, তেমনি কারণ বা উদ্দেশ্যও অভিন্ন। ভিকটিমরা প্রত্যেকেই শিশুকন্যা। আর যারা জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরীণ রয়েছেন, তারা সকলেই বয়সে তাদের চেয়ে অনেক বড়। আলোচিত চারটি শিশুকন্যা হত্যার ঘটনাতেই ঘাতক হিসেবে অভিযুক্তরা ভিকটিমের প্রতিবেশি ও পূর্বপরিচিত। হত্যার আগে ভিকটিমদের ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিটি ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হলেও একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া পশুবৃত্তিক প্রবণতা কিংবা পৈশাচিকতার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাচ্ছে না। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই একই ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধের আরেকটি ঘটনা এসে আলোচনার ঝড় তুলছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ ধরনের একটি শিশু হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, শিশুরা যদি তাদের আশপাশের প্রতিবেশীর কাছে নিরাপদ না থাকে, তা সমাজের জন্য অশনি সংকেত। আসামি একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে নিজের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে ভিকটিমের জীবনে কালিমা লেপন করেছে এবং তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে। উক্ত কাজের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রাণা দাশগুপ্ত পূর্বদেশকে বলেন, শিশুরা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচিতজন কিংবা প্রতিবেশীদের দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকমাত্রই যেখানে শিশুদের পরম মমতা ও ভালোবাসায় বুকে আগলে রাখার কথা, সেখানে চেনা-পরিচিতজনরা শিশুদের পাশবিকতার নির্মম শিকারে পরিণত করছে। এটা কোনওভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সভ্য সমাজে এমন জঘন্য নিষ্ঠুরতা কল্পনাও করা যায় না। এখন প্রতিবেশী কতটা নিরাপদ সেটা ভেবে দেখারও সময় এসেছে।
কেবল অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করেই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আ স ম মাহতাব উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, নগরীতে সংঘটিত প্রতিটি শিশু হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পুলিশ আইনের আওতায় এনেছে। কিন্তু তাদের উপযুক্ত শাস্তিই কী সমাজে প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? আসলে এ ধরনের অবক্ষয়জনিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অপরাধীর শাস্তির পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাশবিকতার মূলোৎপাটনের উপায় খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ ধরণের ঘৃণ্য কর্মকাÐের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে গত ছয় মাসে সংঘটিত পৃথক চারটি শিশুকন্যা খুনের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ পাহাড়তলীর ওয়ার্লেস মুরগীর ফার্ম এলাকার দশ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নীকে অপহরণের পর ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যার ঘটনার শুরুতে থানা পুলিশের নির্লিপ্ততার বিষয়টিও সমালোচিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, থানা পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে আবার থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে সেই রুবেলই পিবিআইয়ের তদন্তে খুনি হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। রুবেলের দেয়া তথ্যেই গত ২৯ মার্চ ভোর রাতে আলমতারা পুকুরপাড়ার ডোবা থেকে শিশু আয়নীর বস্তাবন্দী অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পিবিআই সদস্যরা। তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন আসামি মো. রুবেল। আসামি রুবেল পেশায় সবজি বিক্রেতা এবং ভিকটিম আয়নীর প্রতিবেশি। সবজি বিক্রেতা ছাড়াও আসামি রুবেল থানা পুলিশের কথিত সোর্স ছিলেন। যে কারণে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারে আগ্রহ দেখায় নি।
এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানার পাঁচ বছর বয়সী আলীনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হয়। ১০ দিনের মাথায় পিবিআই সদস্যরা আবির আলীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে নিখোঁজ রহস্য উদঘাটন করে। পিবিআই জানায়, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণের পরিকল্পনা করেছিলেন তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আজহারুলের ছেলে আবির আলী। আদরের ভান করে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকে যাওয়ার পর আয়াত সেখানে চেঁচামেচি শুরু করলে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর ধারালো কাটার ও বটি দিয়ে মরদেহ কেটে ছয় টুকরা করে ব্যাগে ভরে রাখেন আবির আলী। পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে লাশের তিনটি টুকরা বেড়িবাঁধের পর আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকায় সাগরসংলগ্ন খালে ফেলে দেয়। রাতে মরদেহের বাকি তিন টুকরো আকমল আলী রোডের শেষপ্রান্তে স্লুইস গেটের প্রবেশমুখে ফেলে দেয়। এ ঘটনার পক্ষকাল আগে একই বছরের ২৭ অক্টোবর বিকালে নগরীর জামালখান সিকদার হোটেলের পাশে ব্রিজ গলির বড় নালা থেকে মারজান হক বর্ষা (৭) নামে শিশুর লাশ উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। ২৪ অক্টোবর বিকালে ওই এলাকায় নিজেদের ভাড়া বাসা থেকে বিস্কুট কিনতে বের হওয়ার পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। নিহত বর্ষা নগরীর কুসুমকুমারী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। তার বাবা আব্দুল হক মারা গেছেন। মা ঝর্ণা বেগম ও সৎ বাবা মোহাম্মদ ইউছুপের সঙ্গে ব্রিজ গলির বাসায় থাকতো। লাশ উদ্ধারের পর তার মা বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ লাশ উদ্ধারের কয়েকঘন্টার মধ্যেই হত্যারহস্য উন্মোচন ও আসামিকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়। পাড়ার মুদি দোকান শ্যামল স্টোরের কর্মচারি লক্ষণ দাশ (৩০) টাকা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শিশু বর্ষাকে গলির একেএম জামালউদ্দিনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা গুদামে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে পাশের বড় নালায় ফেলে দেয়। ধর্ষণ ও হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার ৩৬ দিন আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বন্দর থানাধীন আবাসিক পোর্ট কলোনির আট নম্বর রোডের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে সাত বছর বয়সী শিশু সুরমা আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের পর থেকেই পুলিশ সন্দেহভাজন এক রিকশাচালকের খোঁজে মাঠে নামে পুলিশ। ঘটনার ২৬ দিন পর গত ১৩ অক্টোবর ভোরে ডবলমুরিং থানার বেপারীপাড়া এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজের সামনে থেকে বন্দর থানা পুলিশ সুরমা ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত সেই রিকশাচালক ওসমান হারুন মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি ওসমান মিন্টু জানিয়েছেন, বিরিয়ানি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকালে হালিশহর কে বøকে ‘স্বপ্ন সুপার শপের’ পাশ থেকে প্রতিবেশী শিশু সুরমা আক্তারকে তার রিকশায় উঠায়। বড়পুল এলাকায় নিয়ে একটি দোকান থেকে কিনে বিরিয়ানি খাওয়ায়। এরপর পোর্ট কলোনির আট নম্বর রোডের মাথায় পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে শিশু সুরমা আক্তারকে ধর্ষণ করে। এসময় শিশু সুরমা যন্ত্রণায় চেঁচামেচি করলে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায়।