পেঁয়াজের ঝাঁঝে একাকার চোখের জল-নাকের জল

50

২০১৯ সালে আলোচিত বিষয় ছিল পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম। যা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। মৌসুমের শেষ দিকে এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে খাবারে পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়েছে অধিকাংশ পরিবার। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাঁধুনিকেও এ নিয়ে ভাবতে হয়েছে। দাম বাড়িয়ে একটি সিন্ডিকেট কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের সংকটের কথা বললেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা সঠিক নয়, এটি সিন্ডিকেটের কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অস্থির হয়ে উঠে পেঁয়াজের বাজার। ২৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে ভারত। বাংলাদেশ আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপরই নির্ভরশীল। ফলে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়তে থাকে। তখন দুই দিনের মধ্যে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়ায় দেশি পেঁয়াজের দাম। ভারতীয় পেঁয়াজও বিক্রি হতে থাকে ১০০ টাকার কাছাকাছি দরে। অবশ্য বাজার তদারকির পর দাম আবার কিছুটা কমে। কিন্তু ক’দিন না যেতে আবারো বাড়তে থাকে দাম। এক পর্যায়ে তা ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।
এবার পেঁয়াজের যে দর উঠেছে, এ রকম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ। নিত্যপণ্যের বাজারে এবারই প্রথম পেঁয়াজ সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের মন্ত্রীরাও রান্নায় তার ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন, যা বিরোধী রাজনীতিকদের আক্রমণের হাতিয়ার হয়েছে।
পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার জন্য আমলারা প্রথম দিকে দায়ী করেছেন ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী-আমদানিকারক আর আড়তদারদের। অপরদিকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরবরাহ ঘাটতি নিয়ে সরকারকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, সময়ের কাজ সময়ে করলে পরিস্থিতি এত খারাপ হত না।
পেঁয়াজের এই সঙ্কটের জন্য খুচরা ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, সরবরাহকারী, আড়তদার এমনকি সরকারের দায় রয়েছে বলে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, এটি এই অঞ্চলের বাজার সঙ্কটের কারণে হয়েছে। আর বাংলাদেশ বেশি বেকায়দায় পড়েছে ভারত আশ্বাস দিয়ে তা ভঙ্গ করার কারণে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে ৩০ শতাংশ সংগ্রহকালীন ও সংরক্ষণকালীন ক্ষতি বাদ দিলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১০ দশমিক ৯১ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এছাড়া চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২ দশমিক ১৩ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। সবমিলিয়ে মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২৯ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। এই হিসেবে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ পেঁয়াজ দেশে আছে তা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও লাগামহীনভাবে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।
১৩ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি মূল্য দ্বিগুণ করে প্রতি টন ৮৫০ ডলার করার পর পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায় ঢাকার বাজারে। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম।
প্রতিকেজি ৩০ টাকা থেকে বাড়তে থাকা পেঁয়াজের মূল্য মাস শেষে শতকের ঘর অতিক্রম করে। অক্টোবর মাসজুড়ে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি দেড়শ থেকে ১৭০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ওই মাসের শেষ দিকে সরকার মিয়ানমার থেকে আমদানি বাড়িয়ে দাম আবার একশ টাকার কাছাকাছি নিয়ে আসে। তবে নভেম্বরের ৯ তারিখে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে নিয়ন্ত্রণের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। নভেম্বরের ১৪ তারিখে ২০০ টাকার ঘর অতিক্রম করে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম। আর এতেই অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে যায়। পরে সেই পেঁয়াজের দাম পৌঁছে যায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা এবং আমদানি কম হওয়ায় সংকট দেখা দেয়। দাম বাড়া নিয়ে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের কোনোধরনের কারসাজি ছিল না। বড় বড় গ্রæপগুলো যদি পেঁয়াজ আমদানি করে তাহলে কখনো সংকট হবে না। তাছাড়া সরকারিভাবেও পেঁয়াজ আমদানি করা দরকার। তাহলে দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। তারা বলছেন, ব্যবসার মূলমন্ত্র বিশ্বাস আর আস্থা। সেটি নষ্ট হওয়ায় এ সংকট।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সময় মতো পদক্ষেপ নিলে বাজার এতো উপরে উঠতো না, দামটা কমই থাকতো। একটা সময় বেঁধে দিতো যে, এতদিন পর্যন্ত আমরা ভারত থেকে এলসি করবো না। তিনি বলেন, দাম বাড়া কমার সাথে আড়তদারদের কোন সম্পর্ক নাই। আমদানিকারকরা যে দরে বিক্রি করতে বলেন, আমরা সে দলেই বিক্রি করি।
শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন সেসময় সংসদে বলেছিলেন, লিন সিজন (পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হওয়ার আগমুহূর্ত) চলছে। এ সময় একটা সংকট থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভারত থেকেও আমদানি চালু হয়েছে। পেঁয়াজের বাজার যেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলে, সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু আছে, কোথাও কেউ যেন বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে।’
পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা নিয়ে এককভাবে কোনো পক্ষকে এখন আর দায়ী করেননি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
নানামুখী উদ্যোগেও যখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, সেই সময় ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পেঁয়াজের সমস্যাটা সাপ্লাইয়ের সমস্যা। সাপ্লাই কম তাই দাম বাড়ছে। সাপ্লাইতে যখন সমস্যা দেখা দেয় তখন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু সুযোগ সন্ধানি তার সুযোগটা নেয়। আমরা যদি সাপ্লাইটা ঠিকমতো রাখতে পারতাম তাহলে তারা এই সুযোগটি নিতে পারত না।
দেশে পেঁয়াজের এই সঙ্কটের পেছনে ভারতেরও ভূমিকা রয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘২৯ সেপ্টেম্বর তারা রপ্তানি বন্ধ করলেও ২৪ অক্টোবর মহারাষ্ট্রের নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তা আবার চালু হবে বলেই আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসায়ীরা দূরের বিকল্প পথ মিশর কিংবা তুরস্ক থেকেও বড় চালান আনতে সাহস করেনি। ২৮ অক্টোবরও যখন তারা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলল না তখন আমরা বড় বিকল্প খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিপদ হচ্ছে মিশুর-তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আনতে ৪০ থেকে ৫০ দিন সময় লেগে যায়। এদিকে বাজারে সঙ্কটের কারণে দ্বিতীয় বিকল্প মিয়ানমারে পেঁয়াজের দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে যায়। তারা (ভারত) যদি এক মাস আগে জানাত তাহলে আমরা বিকল্প মার্কেট থেকে খোঁজ করতে পারতাম।
দেখা যায়, পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস উঠে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম বাড়তে থাকে পেঁয়াজের। খাতুনগঞ্জের অধিকাংশ আড়ত পেঁয়াজশূন্য হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ অন্যত্র সরিয়ে ফেলে। সকালে এক দাম বিকালে আরেক দাম। দিনে কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। দেশজুড়ে বাজারে অভিযান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস, বড় চালান আসার খবর, কোনো কিছুই থামাতে পারেনি পেঁয়াজের দরবৃদ্ধিকে।
পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দামের কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ ব্যাপক চাপে পড়েছে। পেঁয়াজের দাম শুনে মলিন মুখ করে চলে যান নিম্ন আয়ের মানুষেরা। দাম বেশি বলে বাজারে ক্রেতাও কমে যায়। সাধারণ, নিম্ন ও মধ্য বিত্তরা পেঁয়াজ কেনা কমিয়ে দেয়। অনেকে পেঁয়াজ ছাড়াই রান্না করতে থাকে। দুই বা তিন কেজির স্থলে ২৫০ বা ৫০০ গ্রাম পেঁয়াজ কিনে সাধারণ মানুষ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দেশে চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এক-তৃতীয়াংশ আসে ভারত থেকে। ভারত যখন রপ্তানি বন্ধ করে দিল, এই পরিমাণ পেঁয়াজের একটা ঘাটতি তৈরি হলো। এ ছাড়া বন্ধ ঘোষণা করার আগে ভারত কিছু বলেনি। হঠাৎ করেই ঘাটতি হলো। সরকার ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করল অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যাপারে। তবে ব্যবসায়ীরা আমদানির ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাই জোগানের ঘাটতি থেকেই গেল। সরকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে পেঁয়াজ আমদানি করতে অনুরোধ করেছিল। তারা পেঁয়াজ আমদানি করেছে বলে আমি খবর পাইনি। ফলে সব মিলিয়ে দাম বাড়তে থাকল। যাদের কাছে কিছু পেঁয়াজ ছিল তারা দাম বাড়িয়ে দিল। সরকার কিছু অভিযান চালাল, জরিমানা করল। দাম বেঁধে দিল। যাদের কাছে পেঁয়াজ ছিল তারা ভাবল এই দামে তাদের পোষাবে না। তারা বিক্রি করল না। ফলে সংকট তৈরি হলো।
একটি পক্ষ বলছে, পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টি করে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। টিআইবিও এক তথ্যে দেখিয়েছে, পেঁয়াজ সিন্ডিকেট কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তবে সরকারি-বেসরকারিভাবে পেঁয়াজ আমদানির কারণে বর্তমানে পেঁয়াজের দাম আগের তুলনায় কমেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ পেঁয়াজ কেনা অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ-কেউ পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ- কেউ পেঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে বাজারে পেঁয়াজ কেনার প্রবণতা কমে যায়। হোটেল রেস্তোরাঁর মালিকরা তাদের হোটেল ও রেস্তোরাঁয় সালাদে পেঁয়াজের ব্যবহার বাদ দেন। এতে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা দ্রæত কমতে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ে বাজারে। অপরদিকে অনৈতিক মুনাফার লোভে পেঁয়াজের মজুত গড়ে তুলতে থাকেন অসাধু পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। বাজারে পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ব্যবসায়ীরা এ কাজটি করেছেন। এক সময় মজুত করা পেঁয়াজে পচন ধরে। যা নদীতে, ড্রেনে বা ডাস্টবিনে ফেলতে দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কার্গো বিমানে করে মিশর, তুরস্ক ও আফগানিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেসরকারিভাবেও পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়। ফলে দাম কমতে থাকে।