‘পুলিশে ওসি, ডিসি, এসপি ডিআইজি আমাদের চাকর’

269

‘প্রশাসন চলে আমাদের টাকা দিয়ে। প্রশাসন যে কাপড় পড়ে সেটিও আমাদের টাকায়। থানায় লাইট জ্বলে, ফ্যান চলে, গাড়িতে চড়ে সমস্ত আমাদের টাকা। তাঁরা আমাদের চাকর, আমরা তাঁদের চাকর নই। এটা সব সময় মনে রাখবেন। মনে ধারণ করবেন। এটা মনে রাখলেই পৃথিবীর সমস্ত অপশক্তি কাউকে কাবু করতে পারবে না। পুলিশের ওসি, ডিসি, এসপি, ডিআইজি সবাই আমাদের চাকর। এ কথাটি আমি বলেছি বলবেন’।
গতকাল পাঁচলাইশের একটি ভবন থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া রকি বড়ুয়া উপরোক্ত দম্ভোক্তি করেই বক্তব্য দিতেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দেয়া এমন একটি বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। যেটি নিজ বাড়ি লোহাগাড়ার চরম্বা ইউনিয়নে এলাকাবাসীর সংবর্ধনার জবাবে বলেছিলেন বলে জানান গেছে।
সেই বক্তব্যে রকি বড়ুয়া আরো বলেন, ‘আমরা কষ্ট করি, মেহনত করি, তাই ডিউটি করতে পারছি না। যে কারণে নিজে না খেয়ে পুলিশের ওসি, ইউএনও এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে আমরা খরচ দিয়ে চালাচ্ছি। রক্ষক হয়ে ভক্ষক হলে চলবে না। যেখানেই অন্যায় দেখবেন বাধা দিবেন। আমি আছি, সবসময় পাশে থাকবো। আমাকে অনেকেই হুমকি দিয়েছে। আমি কম ভয় পাই। ভয় পেলে বহুদূর যেতাম না। আপনাদের দোয়া আছে, সেজন্য ভয় পাই না। আমরা কষ্ট করলে পরবর্তী প্রজন্ম সুখ পাবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না’। বক্তব্যের এক পর্যায়ে রকি বড়ুয়াকে স্বাগত জানাতে আসা মিছিল থেকে এলাকাবাসী স্লোগান দেয়, ‘রকি ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছার স্বাগতম’।
লোহাগাড়ার চরম্বা ইউনিয়নের বিবিরবিলা গ্রামের জয়সেন বড়ুয়ার ছেলে রকি বড়ুয়া এভাবেই দম্ভোক্তি ও প্রভাব দেখিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতেন। ভিআইপিদের সাথে সুসম্পর্ক আছে- এমন ছবি দেখিয়ে নিজেকে জাহির করতেন নিয়মিত। প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ সবাই তার দাপটে তটস্থ থাকতেন। বৌদ্ধদের ধর্মীয় গুরু পরিচয়ে দাপুটে হয়ে ওঠা রকির এমন প্রভাব এখন ‘জিরো’।
জানা যায়, গত ৩ মে চরম্বা বিবিরবিল শান্তি বিহার ভাঙচুরের ঘটনার পর থেকেই আলোচনায় আসেন রকি বড়ুয়া। সেদিন মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় অন্যদের ফাঁসানো হলেও এ ঘটনাটি রকি বড়ুয়া নিজেই ঘটিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তার এমন আচরণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সুত্রগুলো জানায়, গত ১ এপ্রিল যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সন্তান মাসুদ সাঈদী ও বিতর্কিত জামায়াত নেতা তারেক মনোয়ারসহ কয়েকজন জামায়াত নেতা লোহাগাড়ার বিবিরবিলা বড়ুয়া পাড়ায় গিয়ে রকি বড়ুয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাতভর চলা সেই বৈঠক শেষে পরের দিন ঢাকায় ফিরে যান তারা। সেদিনের বৈঠকের পর থেকেই এলাকায় কানা ঘুষা শুরু হলেও রকির ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি। হঠাৎ করে জামায়াতের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত লোহাগাড়ায় জামায়াত নেতাদের আনাগোনায় আওয়ামী লীগ নেতারাও হতভম্ব হন। অনেকেই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়া জামায়াত পুনরায় উত্থান নিয়েও কানাঘুষা শুরু করেন। তবে রকির ঘনিষ্টজনেরা তখন আশ্বস্ত করে প্রচার করেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুরোধে জামায়াতকে দ্বিধাবিভক্ত করতে বৈঠকক রেছেন রকি। প্রকৃতপক্ষে নতুন করে ষড়যন্ত্র করতেই এই বৈঠকের আয়োজন হয়েছিল বলে জানান স্থানীয়রা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও রকি বড়ুয়ার এমনকর্মকান্ডকে ভালোভাবে নেননি।
ছবিতেই মূল শক্তি
ভারতের প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদি, বিজিপি নেতা অমিত শাহর ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত দিতেন রকি বড়ুয়া। ভারতে থাকাকালীন সময়ে বিজিপি নেতাদের সাথে নিজের ঘনিষ্টতা বাড়িয়েছিলেন রকি। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশেওএনেছিলেন রকি। এতে মানুষের মধ্যে নিজের অবস্থান জাহির করতে সমর্থ হন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, খ্যাতনামা কয়েকজন সাংবাদিক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মো. নেজামুদ্দিন নদভীর সাথে ভালো সখ্যতা দেখাতেন। এমনকি এসব ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলে বিভিন্নজনকে দেখাতেন। কখনো ভিক্ষু সেজে, কখনো সাদা পোশাকে ভিআইপি ব্যক্তিদেও সংস্পর্শে যেতেনরকি। সুযোগবুঝেআখের গুছিয়েনিতেন।অনেকসময় অতিরিক্ত প্রভাব দেখাতে গিয়েবিভিন্ন দপ্তর থেকে বিতাড়নের শিকারও হয়েছিলেন রকি।
দাপটে দিশেহারা প্রশাসন
২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় সচিবকে ইস্যু করে জারি হওয়া সেই প্রজ্ঞাপনে লোহাগাড়া উপজেলার বিবিরভিলা গ্রামের রকি বড়ুয়া কর্তৃক নিজেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু দাবি করে এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টির বিশেষ প্রতিবেদন দেয়ার কথা বলা হয়। ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি জননিরাপত্তা বিভাগের বিশেষ প্রতিবেদন যুক্ত করে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে রকি বড়–য়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু প্রশাসনের নির্ধারিত স্থানে এমন চিঠির কপি পাঠানো হলেও কোনোরূপ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রেজিস্ট্রার্ড ভিক্ষু নয় রকি
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিব এস. লোকজিৎ ভিক্ষু পূর্বদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ধর্মীয় গুরুদের আইডি কার্ড আছে। বাংলাদেশের কোনো সময় রকি বড়ুয়া ভিক্ষু কিংবা শ্রমণ ছিলেন না। ভারতে উনি অনেকদিন ছিলেন। দেশে উনাকে সিভিল পোশাকেই দেখেছি। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ছবিতে দেখেছি। দুঃখের বিষয়- আমাদের উনাকে ভিক্ষু হিসেবে বলা হচ্ছে। কিন্তু তিনি কোনো ভিক্ষু নন।
কখনো তার আমন্ত্রণে যাননি জানিয়ে বৌদ্ধ ধর্মীয় এই গুরু বলেন, ‘আমাকে একবার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি যেতে পারিনি। আমাদের কাছে তিনি কখনো ভিক্ষু হয়ে আসেন নি। আমরা ভিক্ষু মানুষ, শান্তপ্রিয় থাকতে চাই। আমাদের ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। কোনো ঝামেলা হলেই প্রশাসন ও সাংবাদিকদের কাছে যাই। কোনো ক্ষমতাবানের কাছে যেতে হয় না। আমরা ধর্ম প্রচার করি, ক্ষমতা নিয়ে তেমন আগ্রহ থাকার প্রয়োজনও মনে করি না’।
সেদিন বিহারের হামলার ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘বিহার নির্মাণে উনার অবদান আছে। বিহারের ঘটনায় তদন্তে জেনেছি রকি বড়ুয়ার সাথে আরেকটি পক্ষের দ্ব›দ্ব সংঘাত হয়। রাত ৩ টায় পুলিশ যাওয়ার পর ৪ টার দিকে বিহারে হামলা হয়। বিহারের অধ্যক্ষ আমাদের জানিয়েছেন- দু’টি ফায়ার করে হামলা হয়েছে। কিন্তু কারা হামলা করেছে তিনি দেখেননি’।
অবশেষে নারী ও মদসহ গ্রেপ্তার
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাঁচলাইশ এলাকার একটি বাসা থেকে রকি বড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এসময় র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনতলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে পা ভেঙে ফেলে রকি। আহতাবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। ওই ভবন থেকে নারীসহ তার ছয় সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।