পুলিশি তদন্তে ১৭ বছর সিআইডি’র ২০

27

সবুর শুভ

সময়টা ছিল ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল। সামান্য কথা কাটাকাটির জের ধরে খুনোখুনি হয়। বায়েজিদ থানার হিলভিউ এলাকায় সংঘটিত এ ঘটনায় স্থানীয় ফরহাদুর রহমান ছুরিকাঘাত করে বন্ধু শাহাদাত হোসেনকে। এতে শাহাদাতের মৃত্যু হয়। আসামি ফরহাদ স্থানীয় এক প্রভাবশালীর ছেলে। এ ঘটনায় শাহাদাতের পিতা বাদী হয়ে বায়েজিদ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। একমাত্র আসামি ফরহাদুর রহমান। এরপর শুধু তদন্তের চোরাগলিতেই কেটে গেল আড়াই বছর। কিন্তু বিচার শুরু হল না এখনো। থানা পুলিশ ও সিআইডি’র কর্মকর্তারা দফায় দফায় তদন্ত করেছেন মাত্র একজন আসামি থাকা এ হত্যা মামলার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একমাত্র আসামির বয়স নির্ধারণে ডিএনএ টেষ্টও হয়েছে। আসামি ফরহাদের বয়স নিয়ে তদন্তে গোজামিলের শেষ নেই। থানা পুলিশের তদন্তে এক ধরনের তথ্য সিআইডির তদন্তে আরেক ধরনের তথ্য। থানা পুলিশের তদন্তে বাদীর আরেক ছেলেকেও ভিকটিমের ‘সৎ ভাই’ দেখিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অভিযোগপত্রে। আর সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এল ‘আপন ভাই’।
এদিকে ভিকটিম শাহাদাতের বাবা আবদুল হালিম বাদী হয়ে ফরহাদকে একমাত্র আসামি করে দায়ের করা মামলার তদন্তভার পান বায়েজিদ বোস্তামী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোলাম নাসিম। দায়িত্ব গ্রহণের একদিন পর আসামি ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামি ফরহাদ হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
ফরহাদ জবানবন্দিতে দাবি করেন, নিহত শাহাদাত এবং তার ছোট ভাই অপু দুজনই তার বন্ধু। ঘটনার দিন তার সঙ্গে শাহাদাতের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তিনি শাহাদাতকে হত্যার জন্য তার ভাই অপুর কাছ থেকে একটি ছুরি আনেন এবং সেই ছুরি দিয়েই শাহাদাতকে হত্যা করেন। ঘটনার পরপর তিনি ফুপুর বাসায় আশ্রয় নেন এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি বাসার পাশের নালায় ফেলে দেন। এ জবানবন্দির পর পুলিশকে আর ঠেকায় কে? তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পরই ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শাহাদাত হত্যায় তার ছোট ভাই অপুর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র এবং মামলার এজাহারের একমাত্র আসামি ফরহাদের বয়স ১৭ বছর অর্থাৎ কিশোর অপরাধী দেখিয়ে দোষীপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নাসিম। আসামি ফরহাদের বয়স ১৭ বছর দেখানোর অংশ হিসেবে জন্মনিবন্ধন ও একটি স্কুলের প্রবেশপত্র দেখানো হয়। যদিও ফরহাদ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে নিজের বয়স ১৯ বছর বলে স্বীকার করেছিলেন। তাছাড়া গ্রেপ্তারের পর ফরোয়ার্ডিংয়ে এসআই নাসিমও ফরহাদের বয়স ১৯ বলে উল্লেখ করেছিলেন। আবার নিহত শাহাদাত ও অপু আপন ভাই হলেও এসআই নাসিম তার প্রতিবেদনে তারা ‘সৎ ভাই’ বলে উল্লেখ করেন।
তদন্ত কর্মকর্তার এ ধরনের প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ মামলার বাদী ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর আদালতে নারাজি আবেদন জমা দেন। চারদিন পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর আদালত বাদীর নারাজি গ্রহণ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) আদেশ দেন। এরপর মামলাটির দ্বিতীয় দফা তদন্তে যায়।
এরই প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি এসআই হুমায়ুন কবির মৃধাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেন সিআইডি চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার। কিছুদিন তিনি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে অবসরে যান। এরপর মামলার তদন্তভার পান এসআই মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামানও বদলি হয়ে গেলে মামলাটির তদন্তভার পান এসআই মহিউদ্দিন রতন। কিন্তু এসআই মহিউদ্দিন রতন ও বায়েজিদ বোস্তামী থানা থেকে প্রতিবেদন দাখিলকারী এসআই নাসিম ব্যাচমেট হওয়ায় বাদীর আপত্তিতে আবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৮ জুলাই মামলাটির তদন্তভার পান সিআইডির এসআই নজরুল। তদন্তের শুরুতে তিনি আসামি ফরহাদকে রিমান্ডে আনেন। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি বয়স নির্ধারণের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. নুরানি সোলতানা আসামি ফরহাদকে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বয়স ২০ বছরের ওপর বলে মন্তব্য করেন। এরপর ২০২০ সালে ২৫ ডিসেম্বর এসআই নজরুল আসামি ফরহাদের বিরুদ্ধে দোষীপত্রের পরিবর্তে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। এছাড়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নাসিমের প্রতিবেদনে শাহাদাত এবং অপুকে সৎ ভাই বলে উল্লেখ করা হলেও সিআইডির প্রতিবেদনে তারা আপন ভাই বলে উল্লেখ করেন এসআই নজরুল।
এদিকে সিআইডির দাখিল করা সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি ফরহাদের উল্লেখ করা বয়স ১৯ বছরের চেয়ে প্রকৃত বয়স কম দাবি করে তার আইনজীবী আদালতে আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ আগস্ট আদালতে আবার শুনানি হয়।
শুনানি শেষে আসামি ফরহাদের বয়স নির্ধারণ সংক্রান্তে অধিকতর তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে আবার আদেশ দেওয়া হয়। আদালতের আদেশের পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশনায় ফরহাদের বয়সের বিষয়ে আবার তদন্তভার পান এসআই নজরুল। এবার তদন্তের শুরুতে তিনি পাঁচলাইশ থানা শিক্ষা অফিসারের কাছ থেকে একটি তথ্য চেয়ে আবেদন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে থানা শিক্ষা কর্মকর্তা মু. আবদুল হামিদ চিঠি দিয়ে জানান, থানার এসআই নাসিম আসামি ফরহাদের বয়স ১৭ প্রমাণ করতে নতুন কুঁড়ি বিদ্যা নিকেতন নামে যে স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার প্রবেশপত্র দাখিল করেছিলেন, সেটির সত্যতা নেই। কারণ ফরহাদ নামে ওই স্কুল থেকে কোনো শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তার নামে কোনো ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। আবার ২০১৩ সালেই থানা শিক্ষা কর্মকর্তার জায়গায় স্বাক্ষর রয়েছে মু. আবদুল হামিদের। কিন্তু তিনি যোগদান করেছেন ২০১৫ সালে। এতে বোঝা যায় প্রবেশ পত্রটির কোনো সত্যতা নেই।
অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে সিআইডি কর্মকর্তা জানান, আসামি ফরহাদ পড়ালেখা করেছেন ইউসেফ জেনারেল স্কুলে। সেখানে থাকা রেজিস্ট্রার অনুযায়ী ফরহাদের বয়স ২০ এর ওপরে বলে জানা যায়। সার্বিক তদন্ত শেষে গত ৫ সেপ্টেম্বর এসআই নজরুল আসামির বয়স ১৯ বলে আবারও প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে। গত ১১ অক্টোবর বয়স নির্ধারণ নিয়ে থানা শিক্ষা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে শুনানি ছিল। শুনানি শেষে ট্রাইবুনালের বিচারক জামিউল হায়দার তা আদেশের জন্য রেখেছেন। একের পর এক গোজামিলের চোরাবালিতেই আটকে থাকা এ হত্যা মামলার বিচারকাজ এ কারণেই শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানান বাদীর আইনজীবী।
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম জানান, বায়েজিদ থানার তৎকালীন এসআই তদন্ত কর্মকর্তা নাসিম শাহাদাত হত্যায় আপন ভাইকে জড়িয়ে এবং মূল আসামিকে কিশোর অপরাধী সাজিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। সিআইডি কর্মকর্তা এসব ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিয়েছেন। তবে বয়স নিয়ে আসামিপক্ষ একাধিকবার বিভিন্ন আবেদন করায় বিচার শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে।
একই বিষয়ে সিআইডির এসআই নজরুল বলেন, আলোচিত এ মামলার সার্বিক তদন্ত শেষে দুই আসামির বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছি। এক আসামি ফরহাদের বয়স নিয়ে আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন। সেই আদেশের পর আমি আসামি ফরহাদের বয়স তদন্তে যা পেয়েছি, তাই উল্লেখ করেছি। বিচারক বিষয়টি আদেশের জন্য রেখেছেন।
তদন্তের বিষয়ে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই গোলাম নাসিমের বক্তব্য হচ্ছে, গ্রেপ্তার আসামির স্বীকারোক্তি ও তদন্ত সাপেক্ষে নিহতের ভাইকে আসামি করা হয়েছে এবং আসামি ফরহাদের বিভিন্ন সনদ পর্যালোচনা করে বয়স ১৭ উল্লেখ করে কিশোর অপরাধী হিসেবে দোষীপত্র দাখিল করা হয়েছে।
মামলার বাদী আবদুল হালিম জানান, মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নাসিম আমার মেজো ছেলে অপুর নামে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। মূল আসামি ফরহাদকে সাজা থেকে বাঁচাতে ভুয়া প্রবেশপত্র ও জন্মনিবন্ধন তৈরি করে তাকে বানিয়েছেন কিশোর অপরাধী। যদিও সিআইডি সঠিক তদন্ত করে আমার মারা যাওয়া ছেলে এবং আসামি হওয়া ছেলেকে আপন ভাই উল্লেখ করেছে। এছাড়া দু-দফা তদন্ত শেষে আসামি ফরহাদের প্রকৃত বয়স উল্লেখ করে অভিযোগপত্রও দিয়েছেন সিআইডির কর্মকর্তা। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে এখন আমি কি মামলা চালাবো নাকি সংসার চালাবো? আসামিপক্ষের লোকজন চায় আমি যেন এভাবে ঘুরতে ঘুরতে মামলা চালানো বন্ধ করে দিই। আমি জীবন সায়াহ্নে চলে এসেছি। জানি না ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারবো কি না। এখনও শুরুই দেখতে পারলাম না। তার ছেলের হত্যাকারীরা বেশ প্রভাবশালী বলেও কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান এ বৃদ্ধ।