শিখ-মুসলমান যুদ্ধের পর বালাকোট প্রথম ইতিহাসের পাতায় ওঠে আসে। এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটের নাম আবার মিডিয়ায় উঠে আসে। এদিন ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১২টি মিরাজ জেট বিমান কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদ পরিচালিত একটি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে আঘাত করে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিমান হামলাটিকে অসামরিক, স্বতঃপ্রণোদিত বিমান হামলা” বলে অভিহিত করেছেন। এটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম বিমান হামলা ছিল।
তবে পাকিস্তান দাবি করে যে, মুজাফ্ফরাবাদের কাছে ভারতীয় বিমানগুলি তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং বালকোটের কাছে এসেছিল “একটি পেলোড ফেলে দিয়েছে”। তারা বলেছিল যে সেখানে খোলা জায়গা রয়েছে যেখানে ভারতীয় যোদ্ধা বোমা ফেলেছে। কিন্তু কোন হতাহতের বা ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে।
এই ঘটনার পর উভয় দেশের মধ্যে আবার নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের এই অবনতির জন্য পাকিস্তানকেই দায়ী করতে হয়। কারণ উস্কানিটা এসেছিলো পাকিস্তানের তরফ থেকে। পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ যদি প্রথমে হামলা না করতো তাহলে ভারতের তরফ থেকে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রশ্ন উঠতো না। বস্তুত ভারত বহুদিন থেকেই অভিযোগ করে আসছে পাকিস্তানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জইশ-ই-মোহাম্মদসহ কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন সেদেশের ভূখন্ড থেকে এসে বারবার ভারতে ঢুকে হামলা করছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ভারতের এই অভিযোগকে পাত্তা না দেয়ায় জঙ্গিরা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। শুধু ভারতের বিরুদ্ধে এই জঙ্গি মদদের অভিযোগ নয়, তালেবান জঙ্গি উত্থানের জন্যও পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করা হয়। ফলে পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভারতের জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামা জেলার লেথপোরা (আতন্তিপোরোর নিকট) জম্মু শ্রীনগর জাতীয় মহাসড়কে নিরাপত্তা বাহিনীকে বহনকারী গাড়িকে একটি গাড়ি দ্বারা আত্মঘাতী বোমা হামলা করা হয়। এই হামলার ফলে ৪৯ জন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) কর্মী এবং আক্রমণকারীর মৃত্যু ঘটে। এই হামলার দায় পাকিস্তান-ভিত্তিক ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মুহাম্মদ স্বীকার করে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বলেন, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা আক্রমণের পরে ভারতীয় বিমাববাহিনী বালাকোটের একটি জইশ-ই-মোহাম্মদ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের বিরুদ্ধে “অ-সামরিক” এবং “অগ্রক্রয়াধিকার-সংক্রান্ত” হামলা পরিচালনা করেছিল। তিনি আরো বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সরকারের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে আসন্ন বিপদ” সহ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের কথা ভেবে ভারতীয় বিমান বাহিনী বিমান হামলা চালায়। তিনি দাবি করেন, হামলার ফলে জইশ-ই-মুহাম্মদ জঙ্গি সংগঠনের কর্মীরা নিহত হয়েছে। তিনি বলেন যে গোয়েন্দা সূত্র অনুসরণ করে নাগরিকদের ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল বোমা ফেলার জন্য।
এর আগে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় বিমানের দ্বারা আকাশ সীমা লঙ্ঘন সম্পর্কিত পাকিস্তানি অভিযোগ সম্পর্কে তার কাছে কোন তথ্য ছিল না।
পাক-ভারত বিরোধের উৎপত্তি হয় ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ে। তখন অখন্ড ভারতবর্ষকে ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়েছিলো। সে সময় কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়ে যায়। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর মহারাজা হরি সিং গভর্নর জেনারেল লর্ডমাউন্ট ব্যাটেনের কাছে কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করে নেওয়ার জন্য যাবতীয় দলিলপত্র তৈরি করে দস্তখত দিয়ে আবেদন পাঠান। একই সঙ্গে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে তিনি লেখেন, ‘মহানুভবের কাছে আমার বক্তব্য এই আমার মনে হয়, এখনই একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হোক ও শেখ আবদুল্লাহকে এই জরুরি অবস্থা নিয়ন্ত্রণের ভার দিয়ে আমার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হোক।”
এতে দেখা যায়, শেখ আবদুল্লাহ, যাঁকে শের-এ-কাশ্মীর বলা হয়, মুসলমান হলেও তিনিও পাকিস্তানে যেতে চাননি। কারণ তিনি ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সৃষ্টি ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে। সুতরাং পাকিস্তান কখনো কাশ্মীরী মুসলমানদের পছন্দ হতে পারে না।
বাংলাদেশেও পাকিস্তানের মদদে জঙ্গিবাদ বিস্তারের অপচেষ্টা চালানো হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান সরকারের সতর্কতা ও কঠোর পদক্ষেপের ফলে জঙ্গিবাদ এদেশে শেকড় গাড়তে পারেনি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা