পুণ্যতিথি মহালয়া

18

মনোজ কুমার দেব

পুণ্যময় তিথি মহালয়া। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে জগৎজননী দেবী দুর্গা সাড়ম্বরে পূজিতা হন। কৃষ্ণপক্ষের সমাপ্তিতে সূচিত হয় মহালয়ার আর এ মহালয়াতেই ঘোষিত হয় জ্যোতির্ময়ী মায়ের আগমন বার্তা।
মায়ের পূজার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এক-মহালয়া, দুই-বোধন, তিন-সন্ধিপূজা। মহালয়া তিথিটাকে মানা হয় দুর্গাপূজার প্রস্তুতিপর্ব হিসাবে। সনাতন ধর্মের যে কোন শুভ কাজে যেমন বিয়ে, উপনয়ন ইত্যাদির আগে নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ করতে হয়। তেমনি মাতৃআরাধনার আগে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তিলজল নিবেদন করতে হয়। এর মূলে রয়েছে একটি বিশ্বাস। কারো মৃত্যু হলেও তাঁর আত্মার মৃত্যু হয়না। পিতৃপুরুষের অবিনাশী আত্মার তৃপ্তিসাধনের উদ্দেশ্যেই অপরপক্ষে তর্পণ শ্রাদ্ধ। এ শ্রাদ্ধ করেই দুর্গোৎসবের অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া। মহালয়া হলো পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরুর সন্ধিক্ষণ। বলা যায়, মহালয়া থেকে দেবীপক্ষের ক্ষণগণনা শুরু। লোক বিশ্বাস আছে যে, কৈলাস থেকে মা দুর্গা নাকি মহালয়ার দিনেই বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাই মহালয়া তিথিটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিকরা বলছেন যে, ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ নগরী মহীশুরের নামটি এসেছে মহিষাসুর থেকে। এ নগরীতে মহালয়ার দিন থেকেই দেবীপক্ষ ও দেবী আরাধনার শুরু।
সনাতন ধর্ম অনুসারে পিতৃপক্ষে প্রয়াত তিন পিতৃপুরুষের আত্মা এ ধরাধামে নেমে আসে। তত্ত¡গত বিশ্লেষণে ধরার ‘আলয়’ বা গৃহে প্রয়াত আত্মার মহাসমাবেশের নামই ‘মহালয়’। আর ‘মহালয়’ শব্দ থেকে মহালয়া শব্দের উৎপত্তি। তিথি হওয়ায় সংস্কৃত ভাষায় মহালয়া শব্দটি স্ত্রীবাচক। প্রাচীন বেদজ্ঞ ঋষিরা চমৎকারভাবে পিতৃপক্ষের তর্পণবিধি তৈরি করেছেন। এ তর্পণমন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘অতীতে বহুকোটি কুল, বহু জন্মান্তরে গত হয়েছেন সেসব কুলের পিতৃপিতামহাদি ও সপ্তদ্বীপবাসী মানবগণের পিতৃপিতামহাদি এবং ত্রিভুবনের যাবতীয় পদার্থ আমার প্রদত্ত জলে তৃপ্ত হউক।’ তর্পণকারী উচ্চারণ করেন-‘সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা থেকে তৃণরাজি- এ জগতের সকলে তৃপ্ত হউক।’ অসমর্থিত ইতিহাস মতে, ১৪,৪৩৯ বছর আগে ১৬ ভাদ্রের অমাবস্যা তিথিতে স্মরণকালের এক মহাপ্লাবন বা মহাপ্রলয় হয়েছিল। উঁচু মালভূমি ছাড়া পৃথিবীর অধিকাংশ নিমজ্জিত হওয়ায় ব্যাপক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বৈদিক ঋষিগণ এ দিনটির স্মরণে পক্ষকালব্যাপী তর্পণের প্রণিধান দিয়ে গেছেন।
পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। দেবতাদের যুথবদ্ধ শক্তির ধারক ‘দশপ্রহরণধারিণী’ দেবী দুর্গা নয় দিনের যুদ্ধে অশুভের প্রতিভূ মহিষাসুরকে বধ করেন। এ জন্যই শুক্লপক্ষের দশমী তিথি চিহ্নিত হয়ে আছে বিজয়ের স্মারক ‘বিজয়া দশমী’ হিসেবে। মহালয়ার শুভময় তিথিতে মনকে ধীর করে হৃদয়কে বানানো হয় পবিত্র মন্দির। তারপরই জগৎজননী দেবীকে হৃদয়ে অধিষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
শুভ মহালয়ার সাথে সম্পর্কিত দেবী মহামায়ার আবির্ভাব কাহিনী। এ মহামায়ার কাহিনী বিবৃত হয়েছে ঋষি মার্কন্ড রচিত পুরাণে। মার্কÐেয় পুরাণের তেরোটি অধ্যায়ের শ্রীশ্রীচÐী মহাগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে মহামায়া বন্দনার এক অপূর্ব কাহিনী। চৈত্র বংশীয় বিখ্যাত রাজা সুরথের কাহিনীকে ঘিরেই বিস্তৃত হয়েছে মহামায়ার স্বরূপ উন্মোচনের তিনটি বিখ্যাত আখ্যান। মুনিবর মেধসের নির্দেশিত সাধনায় রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি দেবী মহামায়াকে তুষ্ট করে কৃপা লাভ করলেন।
মহালয়ার সাথে মায়ামমতা আর স্নেহের এক বন্ধনের কথা জড়িয়ে আছে। জীবদ্দশায় অন্নজল পান না অনেক বাবা-মা। একসময় জগতের নিয়মেই এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তাঁরা। তবুও এক অপত্য স্নেহের টানে তাঁরা নেমে আসেন এ ধরায়। তাইতো পূর্বসূরিরা আমাদের প্রণম্য।
আজ শুভ মহালয়া থেকেই ক্ষণগণনা শুরু হলো মাতৃআরাধনার। তাই আসুন ঐতিহ্য আর পরম্পরাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। প্রতিজ্ঞা করি আত্মজাগরণ ও আত্মশুদ্ধির।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ