পুঁজিবাদ ও কিছু কথা

36

রোমেনা আফরোজ

বাঙালি সমাজে নারীর বিরুদ্ধে বহু কথা প্রচলিত আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে কুসুম চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন, মেয়ে মানুষ এরকম হয়, ওরকম হয়, সবরকম হয়, শুধু মনের মত হয় না। আমাদের সমাজের অধিকাংশ গালি নারী কেন্দ্রিক। যেমন পুরুষ রাগলে হয় বাদশাহ, নারী রাগলে হয় বেশ্যা ইত্যাদি। যে নারী ছাড়া পুরুষের এক মুহূর্তও চলে না, সেই নারীকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য অপবাদ, কুৎসা। নারীকে ক্ষুদ্র করে পুরুষ যেন পেতে চায় শ্রেষ্ঠত্বের মহান দরজা।
আধুনিকতার ছোঁয়া এখন সবখানে, বেড়েছে শিক্ষার হার। তারপরেও কেন দিনকে দিন বাড়ছে নারী-পুরুষের মধ্যকার দূরত্ব? কেন তারা বুঝে উঠতে পারছে না একে-অপরকে? শুধুমাত্র সঠিক শিক্ষার অভাবে সমস্যাটা যে বাড়ছে তা নয়, এজন্য সাংস্কৃতিক বিমুখতাও দায়ী।
সুচিন্তা করার জন্য শিক্ষা-দীক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এখনো ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত নয়। এ ব্যবস্থা যেন মানুষকে করে তুলছে আরও বেশি বৃত্তবন্দি। মানুষ না পারছে নিজস্ব সংস্কৃতির কাছে ফিরে যেতে, না পারছে মুক্ত হতে। শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানো প্রয়োজন, যাতে বোধের জায়গাটা পোক্ত হয়, যাতে পুঁজিবাদ এসে ফায়দা লুটতে না পারে। সমাজ যদি জ্ঞানভিত্তিক না হয়, তবে অরাজকতা সৃষ্টি হবেই, মানুষে মানুষে সৃষ্টি হবে দূরত্ব। এই যে আমাদের ভাবনায় পুরুষতন্ত্র কিংবা নারীবাদ এসে জায়গা দখল করে নিয়েছে এজন্য সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষ তৈরির কারখানা নয়। সেখানে মানুষ তৈরি হয় না। সেখানে তৈরি হয় দাসশ্রেণি। এই বোধশূন্য প্রাণিরা দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে, একে-অপরকে দোষারোপ করবে এটাই স্বাভাবিক।
তবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য একতরফাভাবে পুরুষকে দায়ী করাটা বোধ হয় অযৌক্তিক। কারণ নারী নিজেও জানে না নিজের হরমোনের সাতকাহন।
নারী-পুরুষের মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান আছে। এটা প্রকৃতিপ্রদত্ত। মাসিক চক্রের শুরুর দিকে এস্ট্রোজেন, ওভ্যুলেশনের সময় পজেস্টেরন কাজ করে। এ দুটি প্রধান হরমোন ছাড়াও নারীদেহে আরো অনেক হরমোন আছে। এসব হরমোনের প্রভাবে মেয়েদের মানসিক অবস্থা ঘনঘন পরিবর্তিত হয়। কোনো কারণে যদি একবার হরমোন ভারসাম্যহীন হয়, তবে তো জটিলতার অন্ত নেই। ‘নো থাইসেলফ’ নামে একটা গ্রীক দর্শন আছে, যার অর্থ নিজেকে জানা। এই পুঁজিবাদী যুগে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ; এক কথায় অপরিহার্য। একমাত্র নিজেকে জানলে যেকোনো সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের পাওয়া যায়। কিন্তু বাঙালি নারী নিজের শরীর সম্পর্কে জানে খুব কম। তাদের সত্তাজুড়ে পরনির্ভরশীলতার বীজ ছড়িয়ে আছে। এজন্য নারী-পুরুষের মানসিক উচ্চতাও এক নয়।
এবার আসি পুরুষের প্রসঙ্গে। পুরুষের তুলনায় নারী শরীর অনেক বেশি সংবেদনশীল। এ সম্পর্কে বাঙালি পুরুষ জানে একেবারে কম, বোঝে তার চেয়েও অনেক বেশি। পুরুষতান্ত্রিকতা সবসময় চেয়েছে নারীকে দাবিয়ে রাখতে। তাই শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে অবলোকন করেছে নারীর প্রকৃতিকে। অথচ একটা বিষয়কে বুঝতে হলে সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তার কাছাকাছি যেতে হয়। প্রবেশ করতে হয় অন্দরবাড়িতে। নারীকেও বুঝতে হলে হরমোন, হরমোনের সাথে মুডের উঠানামা এবং পুঁজিবাদের ফলে নারীদেহে যে-ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, তা জানতে হবে। ‘দ্য ফেমেইল ব্রেইন’ বইয়ে খড়ঁধহহ ইৎরুবহফরহব বলেছেন, নারীর অনুভূতির কম্পার্টমেন্ট পুরুষের তুলনায় বড়। এ কারণে নারীরা ভাবে বেশি। অনেক খুঁটিনাটির হিসাব থাকে তাদের কাছে। এদিকে পুরুষ বন্দি হয়ে আছে খেলাধূলা, রাজনীতি এবং যুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে। এই মানসিক বৈপরিত্যের কিছুটা জন্মগত, কিছুটা সাংস্কৃতিক। সাংস্কৃতিক ত্রæটি একজন মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে একসময় হয়ে যায় সহজাত বৈশিষ্ট্য। সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করা যায় মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। বিখ্যাত বায়োলজিস্ট ব্রæস লিপটন এমন কথাই বলেছেন তাঁর ‘বায়োলজি অভ বিলিফ’ বইয়ে।
প্রযুক্তির উন্নতির জন্য শহরে মানুষের এখন কায়িক পরিশ্রম হয় না বললেই চলে। সা¤প্রতিককালের এক রিপোর্টে ডবিøউএইচও বলেছে, বিশ্বের প্রায় ১৪০ কোটি মানুষ কোনো ধরনের কায়িক পরিশ্রমের সাথে জড়িত নয়। আবার ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুডের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসুখবিসুখ। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ত্রিশ শতাংশের কাছাকাছি থাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত। এখনই আমাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় পরিণাম হবে ভয়াবহ।
বর্তমানে নারী-পুরুষ এমনকি মানুষে মানুষেও দূরত্ব বেড়েছে। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকর্ম, গবেষণা হয় না বললেই চলে। একটা জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি ফেলে অপর দেশীয় সাংস্কৃতিক পরম্পরা ধারণ করে পথ চলছে। এটা বিপদজনক। এক্ষেত্রে দায় এসে পড়ে বুদ্ধিজীবীদের উপর, সাধারণ মানুষের উপর। যেহেতু প্রলেতারিয়েত শ্রেণি থেকে বিপ্লক সংগঠিত হয়েছে একেবারে কম, সেক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের মত বুদ্ধিজীবীরাও যদি বুদ্ধি বিক্রিতে মেতে উঠেন, তবে দেশকে গ্রাস করে নেবে পুঁজিবাদী চক্র। ইতোমধ্যেই আমাদের শহুরে ব্যবস্থার উপর পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ ছাপ ফেলেছে। পরিবর্তনের নামে গ্রামের দিকেও চলছে অপসাংস্কৃতিক তৎপরতা।
সা¤প্রতিক সময়ে যারা সাহিত্যচর্চা করছেন, যাদের পুঁজিবাদ ও সাংস্কৃতিক বিমুখতা নিয়ে প্রতিবাদ করার কথা, তাঁরা গ্রুপিজমে ব্যস্ত। তাঁরা বৃত্তের বাইরে যান না। সাধারণের কথা ভাবার শক্তিও তাঁদের নেই, যদিও কয়েক বছর ধরে পরিবর্তনের হাওয়া ঘূর্ণি তুলছে। অনেকে বিদেশি সাহিত্যের দিকে ঝুঁকছেন। অনুবাদ হচ্ছে। এসবের অর্থ যদি নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে বাতিল করা হয়, তবে সেটা হবে বোকার স্বর্গ। নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ভেতর দিয়েই মানুষকে পথ চলতে হয়। তবেই সম্ভব আত্মিক মুক্তি। তবেই মানুষে মানুষে কমবে দূরত্ব। নারী-পুরুষের মধ্যে তৈরি হবে ভালোবাসার বন্ধন।

অনেকে সাহিত্য বলতে একটা বৃত্তের মধ্যে অন্তরীণ হয়ে আছেন। তাঁরা বেছে বেছে কবিতা, উপন্যাস পড়েন। অনেকে সাহিত্য বলতে মেডিকেল সায়েন্সের বইগুলোকে স্বীকৃতিও দিতে চান না। চারবছর পূর্বে আমি যখন মেডিকেল আর্টিকেল নিয়ে পড়ছিলাম, অল্পবিস্তর লিখছিলামা, তখন অনেকে বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের মত এমন উদার ক্ষেত্রে একজন মানুষ যদি নিজেকে মুক্তভাবে প্রকাশ করতে না পারেন, তবে আধুনিকতার অর্থ মলিন হয়ে যায়। আধুনিকায়নের ফলে যেভাবে অসুখবিসুখ বাড়ছে তাতে মেডিকেল সায়েন্সকে বাদ দিলে অসুস্থতা যমদূতের মত চেপে বসবে। তাতে লুপ্ত হবে চিন্তাশক্তি।
সেদিন তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিদের কথায় কান না দিয়ে নিজের মত পড়েছি; নিজেকে নিয়ে মগ্ন ছিলাম। তাতে মন নিয়ন্ত্রণের মত জটিল বিষয় নিয়ে এখন ভাবতে পারছি। মনে রাখতে হবে, একজন নিয়ন্ত্রিত মানুষকে কখনো নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদ দখল করতে পারে না।

ছোটবেলা থেকে সবার মত আমার মনেও গেঁথে দেয়া হয়েছিল সংসারের বীজ। সেই স্বপ্নে বুঁদ হয়ে গড়পড়তা লেখাপড়া করেছি। যতটুকু পড়েছি সবটুকু ছিল মুখস্থ বিদ্যা। তাই বোধের জায়গা তৈরি হয়নি। পুঁজিবাদী যুগে কী করে মানসিক সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হয় সে-সম্পর্কে আমি ছিলাম পুরোপুরি অজ্ঞ।
নিজেকে নিয়ে আগ্রহ বোধ করেছি ছত্রিশ বসন্ত অতিক্রম করার পর এবং পড়তে শুরু করেছি অনেকটা বাধ্য হয়ে। পূর্বে সংসারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছি। গড়ে উঠেছিল অভিযোগের পাহাড়। হরমোন ইমব্যালেন্স হওয়ার পর নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছি, কেন এমন হলো? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে সুস্থতা নামক সোনার হরিণ? এসব ভাবতে ভাবতে আরও বেশি হয়েছে অ্যাঙজাইটি, স্টেস। একটা জটিল বৃত্তে দীর্ঘ বছর বন্দি ছিলাম।
যেহেতু এখন একক পরিবার প্রথার প্রচলন, তাই একমাত্র ছেলে কলকাতা চলে যাবার পর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। আঠারো সালের দিকে অ্যাঙজাইটি, স্ট্রেস আক্রমণ করে। তখন আমার নিজস্ব কোনো জগত ছিল না। টুকটাক লেখালিখি করছিলাম ঠিকই; কিন্তু নিজেকে মগ্ন রাখার মতো তেমন ব্যস্ততা আমার ছিল না। একাকীত্ব দূর করতে একজন বন্ধু হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম। কিন্তু পুঁজিবাদী যুগে মানুষ পাবো কোথায়!
অসংখ্য ট্রমার মধ্যে দিয়ে আমার কেটেছে এক একটি প্রহর। সাইকিয়াটিস্ট দেখিয়েছি। ডাক্তার ও ঔষধ পরিবর্তন করেও কোনো উপকার পাইনি। উপরন্তু জটিলতা বাড়ছিল। একবার ঢাকায় যেয়ে মেডিসিন এবং ডায়াবেটিক ডক্টর দেখিয়েছিলাম। তাঁর সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানলাম, মানুষের দুঃখ কষ্ট জমা থাকে অবচেতন মনে। সেই প্রথম সাবকনশাস মাইন্ডের কথা জানলাম। যেহেতু অবচেতন মন সম্পর্কে আমি অজ্ঞ ছিলাম, তাই অ্যাঙজাইটির বৃত্ত থেকে বের হতে পারছিলাম না। যেহেতু মেডিকেল সায়েন্স জটিল বিষয়, তাই বারবার থেমে যেতে হয়েছে। কনশাস-সাবকনশাস মাইন্ড নিয়ে দিনকে দিন আগ্রহ বাড়ছিল। মন এবং যুক্তি বলছিল, এ পথে হাঁটলেই নিজেকে জানতে পারব। নিয়ন্ত্রণ করতে পারব মানসিক অবসাদ। বহুবার সিম্প্যাথেটিক, প্যারাসিম্প্যাথিটিক-এর গোলকধাঁধায় আটকে পড়েছি; তবুও থেমে থাকিনি। অর্গানিক খাবারের দিকে ঝুঁকেছি। ব্যায়াম করেছি প্রতিদিন। সচেতন হয়েছি ভিটামিন ডি সম্পর্কে। কিন্তু তারপরেও সমস্যা পুনপুন বিপর্যস্ত করছিল। একবার নার্ভাসনেস নৈরাজ্যবাদী আচরণ করছিল। কোনোমতে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না করতে আরেক সমস্যাÑশরীরে কী যেন হাঁটছিল। এক প্রকার সেনসেইসন। মাঝেমধ্যে ক্লাটোফোবিয়া আক্রমণ করত। মাথার মধ্যে কুয়াশাচ্ছন্ন ভাব হতো। একটু স্থির হয়ে যে ভাববো কিংবা লিখবো সেই ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়েছিল। সেই ভয়াবহ দুর্যোগে কারো সমর্থন পাইনি। তারপরেও সারাক্ষণ নিজেকে সাহস দিয়েছি। ভেবেছি ইতিবাচক ভাবনা।
একসময় নিউরোজেনেসিস পড়ার পর মনে একটা নতুন ধারণা তৈরি হল; তৈরি হল নতুনবোধ। সেই পথ চলতে চলতে জানলাম, মানুষের মধ্যে অপার শক্তি আছে। আসলে মানুষ হলো ¯্রষ্টার ক্ষুদ্রকতার বিচ্ছুরণ। মানুষ চাইলে বাড়াতে পারে স্মরণশক্তি, বুদ্ধিমত্তা। মানুষ চাইলে যা হতে চায় তাই হতে পারে। এজন্য সাবকনশাস মনকে জানাটা অপরিহার্য। এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর এখন প্রায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে হয়, জীবন এত ছোট কেনে!
পরিশেষে, কোনো বিষয়কে উপভোগ করতে হলে চর্চা প্রয়োজন, যাকে বলে সাধনা। সেখানে নারীর মত একটা জটিল বিষয়কে অনুভব না করে, কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যে মোহিত হলে নারীর প্রতি আচরণটা কখনোই নিরপেক্ষ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে অপবাদ আরোপ করা খুব সহজ। আর সে-কারণেই বাড়ছে নারী-পুরুষের মধ্যকার দূরত্ব।
লেখক : সাহিত্যিক, প্রবন্ধিক