পিডিবি বলছে ভুল বোঝাবুঝি গ্রাহক বলছেন হয়রানি

8

নিজস্ব প্রতিবেদক

চকবাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিদ্যুতের লাইন মেরামতে ঘুষ দাবির সংবাদ প্রকাশের পর তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত ৭ জুন দৈনিক পূর্বদেশের শেষ পাতায় ‘ঘুষ না দিলে বিচ্ছিন্ন করা হয় সংযোগ’ শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয়। এ সংবাদের জেরে তদন্ত কমিটি গঠন করে পিডিবি। এতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একজন উপ-পরিচালক ও দুইজন সহকারী পরিচালককে রাখা হয়। তদন্ত কমিটি দুই মাস পর প্রতিবেদন প্রদান করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বকেয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্নকালে গ্রাহক এবং বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ (বিবিবি)- পাথরঘাটা দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে একটি ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি বা অনৈতিক কর্মকান্ডের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে গ্রাহক বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনটি মনগড়া। তারা তাদের নিজস্ব মানুষ দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ভুল প্রতিবেদন দিয়েছেন। আমরা হয়রানির শিকার হয়েছি, এটা সত্য।
সংবাদে চকবাজারের গ্রাহক মো. আইয়ুব বিদ্যুৎ সংযোগে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের বিষয়টি বিদ্যুৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক বরাবর অভিযোগ প্রদান করেন।
অভিযোগে তিনি বলেন, প্রকৌশলী মো. নাজমুল হোসেন ভূঁইয়া বেশ কিছুদিন ধরে আমার মার্কেটে গিয়ে আমাকে ডেকে কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। তার প্রস্তাবে আমি রাজি না হওয়ায় গত ২৫ মে সকাল বেলা আমার মার্কেটে মিটারের লাইন কেটে দেন। আমি তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি লাইন লাগানোর জন্য আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। আমি আমার বিলের কাগজ পেইড দেখালে আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন। অথচ আমি ১৮ মে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছি। তারপর আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকতার সাথে যোগাযোগ করলে গত ২৬ মে সকাল ১০ টায় আমার লাইন পুনরায় লাগিয়ে দেন। তবে এর আগে আমার মার্কেটের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভাড়াটিয়ারা আমাকে নানাভাবে হেনস্থা করেন। তাই বিষয়টি বিবেচনা করে ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।
এদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগটি পর্যালোচনায় প্রকাশিত সংবাদটি দেখা হয়। এতে বিবিবি- পাথরঘাটা, বিউবো, চট্টগ্রাম দপ্তরে কর্মরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের বিষয়ে বলা হয়। তবে তদন্তে অনৈতিক সুবিধার বিষয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। এসবের প্রেক্ষিতে গ্রাহক মো. আইয়ুবের গ্রাহক আঙ্গিনা পরিদর্শন করা হয়। বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ- পাথরঘাটা এবং গ্রাহক আঙ্গিনায় এর তথ্যমতে মো. আইয়ুব এবং তার পরিবারের নামে একই আঙ্গিনায় মোট ২৩টি মিটার আছে। গ্রাহক লেজার এবং ২৩টি হিসাবের বিপরীতে ৬৬ হাজার ৭০৫ টাকা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া সরেজমিন পরিদর্শনকালে গ্রাহককে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। তবে গ্রাহকের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
পরবর্তীতে গ্রাহক মো. আইয়ুবের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তিনি নিজে সরাসরি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না। ভাড়াটিয়াগণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকেন। কোভিড -১৯ এর কারণে কিছু কিছু দোকান বন্ধ রয়েছে, তাই কোন কোন দোকানের সামান্য কিছু টাকা বকেয়া থাকতে পারে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি অনুরোধ করেন, যদি কোন হিসাবের বিপরীতে কোন বকেয়া থাকে, তাহলে শুধুমাত্র ঐ হিসাবের লাইনটি যাতে বিচ্ছিন্ন করা হয়, একটি হিসাবের বকেয়ার জন্য অন্যান্য সকল ব্যবহারকারীর লাইন যাতে বিচ্ছিন্ন করা না হয়। এছাড়া কোন নির্দিষ্ট হিসাবের বকেয়ার বিষয়ে তাকে অবহিত করা হলে তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীর সাথে যোগাযোগ করে বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান।
তবে পাথরঘাটা দপ্তরের সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দল জানান, সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের সবগুলো মিটার একই সার্ভিস তারের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ায় আলাদা করে বকেয়াধারী কোন মিটারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই। কোন মিটারের বকেয়ার কারণে সার্ভিস তারটি বিচ্ছিন্ন করলে সংশ্লিষ্ট সকল মিটারের সংযোগই বিচ্ছিন্ন হয়। এ ব্যাপারে গ্রাহক প্রতিনিধির সামনে সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দল বিষয়টি ইতোপূর্বে গ্রাহককে একাধিকবার মৌখিকভাবে জানিয়েছেন বলেও জানান এবং প্রি-পেমেন্ট মিটার প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করেন।
পাথরঘাটা দপ্তরের সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলের সাথে আলাপকালে আরো জানা যায়, একটি হিসাবের বকেয়ার বিষয়ে গ্রাহক মো. আইয়ুবের প্রতিনিধি এবং দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে ভুল বুঝাবুঝির অবতারণা হয়। ফলে, বকেয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে একটি হিসাবের বকেয়ার বিষয়ে গ্রাহকের মতে পরিশোধিত কপি তিনি দেখিয়েছেন, অন্যদিকে পাথরঘাটা দপ্তরের সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলের মতে গ্রাহক তাৎক্ষণিকভাবে কপি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
দপ্তরের সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলের সদস্যগণ জানান, সংযোগ বিচ্ছিন্নকালীন সময়ে গ্রাহক মো. আইয়ুব সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলের সঙ্গে মোবাইলে অশোভন আচরণ ও গালিগালাজ করেন। এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও প্রদান করেন। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির নিকট সংশ্লিষ্ট মোবাইল কথোপকথনের অডিও ক্লিপটিও পেশ করা হয়। গ্রাহক মো. আইয়ুবকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি এর সত্যতা স্বীকার করেন এবং তার অনাকাক্সিক্ষত আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গ্রাহক মো. আইয়ুব “উপ-মহা ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঢাকা, বাংলাদেশ সচিবালয়” বরাবরে লেখা অভিযোগ পত্রটি পর্যলোচনা করে দেখা যায়, অভিযোগ পত্রটিতে গ্রাহকের কোনো স্বাক্ষর নেই। পাথরঘাটা দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট দপ্তরটি নিয়ন্ত্রণকারী ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা বরাবরেও কোনো অনুলিপি প্রদান করা হয়নি। অভিযোগপত্রটিতে ২ জুন ২০২১ তারিখে বিবিবি- পাথরঘাটা দপ্তরের নিম্নমান হিসাব সহকারী, বিউবো, চট্টগ্রাম এর সিলমোহরযুক্ত একটি স্বাক্ষর দেখা যায়। এ ব্যাপারে বিবিবি- পাথরঘাটা দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী লিখিতভাবে জানান যে, “উক্ত পদে অত্র দপ্তরে কেউ কর্মরত নাই এবং অত্র দপ্তরের কারো স্বাক্ষরের সাথে স্বাক্ষরটির মিল নাই”। পরবর্তীতে গ্রাহক মো. আইয়ুব এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির সাথে দেখা করবেন বলে জানালেও তিনি দেখা করেননি।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ও বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. সহিদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, বকেয়ার কারনে সংযোগ বিচ্ছিন্নকালে গ্রাহক এবং পাথরঘাটা দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে একটি ভুল বুঝাবুঝির অবতারণা হলেও উপ-সহকারী প্রকৌশলী নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি ও অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাÐের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া আপনাদের প্রকাশিত সংবাদটির উৎস হিসাবে গ্রাহকের যে অভিযোগপত্রটি পেশ করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। পাথরঘাটা দপ্তরের গ্রাহকগণকে যেহেতু প্রিপেইডের আওতায় আনা হচ্ছে, তাই এ ধরনের পরিস্থিতি নিরসনকল্পে জরুরি ভিত্তিতে হিসাব সমূহের সংযোগ প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার ব্যবস্থা চলছে।
তবে ভূক্তভোগী গ্রাহক মো. আইয়ুব পূর্বদেশকে বলেন, তাদের করা তদন্ত কমিটি তাদের মতই হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তদন্ত কমিটির লোকজন তাদের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কখনো খারাপ প্রতিবেদন দিবে না। আমরা হয়রানির শিকার না হলে অভিযোগ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল আমাকে পুনরায় নির্বাহী প্রকৌশলী বা প্রধান প্রকৌশলী বরাবর অভিযোগ প্রদান করতে। আমি আর কোন অভিযোগ দিইনি। এখন তারা তাদের যা ইচ্ছে, তা করে যাচ্ছে। শুধু আমি নই, চকবাজারে এরকম অনেক গ্রাহক আছেন, যারা নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সবাই তো আর অভিযোগ দিতে পারেন না। আমি দিয়েই বুঝেছি, পরিণাম কি হয়।