পাহাড় কাটা বন্ধ হবে কবে?

22

পরিবেশ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় ও জেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় ব্যাপক অভিযান, আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের পরও চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় কাটার লাগাম টানা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম নগরী ও আশেপাশের পার্বত্য জেলা উপজেলার শতাধিক পাহাড় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতার প্রভাব কাটিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রæপ এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যও অবৈধ দখল করে বসতি গড়ছে। শুধু তাই নয়, বিক্রি করা হয়েছে সরকারি পাহাড়ের দখলস্বত্ব। দখলকৃত পাহাড় কেটে তৈর করা হচ্ছে, বড় বড় স্থাপনা, আবাসিক এলাকা, শিল্পকারখানাসহ বস্তিনিবাস। কোন কোন স্থানে স্বয়ং সরকারের সহযোগী সংস্থা পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
গতকাল রবিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাহাড়ি সৌন্দর্য্যরে রূপকন্যার বুকে তথা এ চট্টগ্রামে মনুষ্য আবাস গড়তে পাহাড় কাটা শুরু হয়েছে আড়াইশ বছর আগে। ইংরেজ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবাসিক করার জন্য পাহাড় কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে। ইংরেজ শাসনের পর পাকিস্তান আমলেও কমেছে পাহাড়ের সংখ্যা। স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে। এরপরের ১৩ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে আবাসন গড়তে চলেছে যাচ্ছেতাইভাবে পাহাড় নিধন। পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে ৫০ টিরও বেশি বিলাসী আবাসিক এলাকা। ফলে নগরী হারিয়েছে অনন্য প্রাকৃতিক রূপ, বিশুদ্ধ পরিবেশ হয়েছে বিষাক্ত। সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে পাহাড় নিধন, শিল্পায়নের অজুহাতে খেকোদের রক্তচক্ষুর খোরাক হয়েছে পাহাড়ি মাটি-বালু। এসব পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের সংবাদ গণমাধ্যমে পাওয়া যায়, তাতে আর্থিক জরিমানাসহ গ্রেফতারকৃতদের দন্ডের খবর পাওয়া গেলেও আইনের মারপ্যাঁচে মুক্তি পেয়ে আবারও পাহাড় দখল ও কাটার কাজেই নেমে পড়ে এসব অপরাধিরা। প্রকৃতির বুকে এমন ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞের ভয়াবহ পরিণতির কি মানুষ সইতে পারবে?
এভাবে চট্টগ্রামের ১৭টি সরকারি পাহাড়ের সব ক’টিই এখন দখলদারদের দখলে। পরিবেশ অধিদফতর কাউকে কাউকে জরিমানা করছে বটে, কিন্তু তাতে বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় কাটা। জরিমানা দিয়ে অনেকে পুনরায় পাহাড় কাটছে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জরিমানা দেয়া বা কয়েকদিনের শারীরিক দÐ মানে পাহাড় কাটার বৈধতা পাওয়া।
পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে তাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন , অভিযান যদি নিয়মিত পরিচালনা করা হয়ই, তাহলে পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না কেন? দ্বিতীয় কথা, জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যারা পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত এমনকি সরকারি সহযোগী প্রতিষ্ঠানও যদি জড়িত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন এবং বনজঙ্গল ও গাছপালা উজাড় করার কারণেই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘনঘন পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল ও গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন মজবুত রাখে। পাহাড় কাটার কারণে সেই বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পাহাড় ধসের পথ সুগম হয়। পরিণতিতে প্রতিবারই প্রাণ হারায় মানুষ। বস্তুত কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাÐের দরুন প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে।
নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে শুধু পাহাড়ধস নয়, এর ফলে একদিকে চট্টগ্রাম নগরী দিনদিন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালিতে নগরীর নালা-নর্দমা ভরাট হওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। সম্প্রতি মুরাদপুরে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ায় নালায় এক পথচারি পড়েগিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিন পরও তাকে না পেয়ে সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ধারণা করেছে, ড্রেনে পাহাড়ি ঢলের মাটিচাপা পড়েছে নিখোঁজ পথচারি। তাদের এ বক্তব্য এখনও কেউ খন্ডন করেনি। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। পরোক্ষভাবে পাহাড় দখল ও নিধনকারীরা এর দায় এড়াতে পারেনা।
২০০৭ সালের মর্মান্তিক পাহাড়ধসের ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি পাহাড়ধসের ২৮টি কারণ নির্ণয় করে ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করেছিল; কিন্তু সেগুলো আজও বাস্তবায়িত হয়নি। মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক না হলে আমাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সেই দায় শোধ করতে হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটা রোধে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে- এটাই প্রত্যাশা।