পাহাড়ধসে ফসলের ক্ষতি

12

মো. নুরুল করিম আরমান, লামা

টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি, জমিতে পলি জমে ও পাহাড় ধসে এবারে বান্দরবানের লামা উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা, বনপুর ও গয়ালমারা এলাকায়। এখানের বেশির ভাগ কৃষক এনজিও, ব্যাংক অথবা চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণের টাকা নিয়েই ফসল আবাদ করেন। এখন ফসলহানিতে এসব এলাকার সাড়ে তিনশ কৃষকই দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন। সরকারিভাবে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে, বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ বেশি বলে দাবি কৃষকের। এ ক্ষতিতে নিজেদের খাবারতো জুটবেই না, বরং খাদ্যাভাবে পড়বে পোষা গরু ছাগলও। এ অবস্থায় সরকার সহায়তা না করলে ভিটেবাড়ি বিক্রি ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা বলে জানান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা। জানা যায়, উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন পাহাড় ও খালের দু’পাড়ের জমিতে রকমারী সবজির আবাদ করেন কৃষকরা। গত মে মাস থেকে তারা জমিতে আবাদ শুরু করেন ধান, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, তিত করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, শসা, দেড়শ, খিরা, শসা, বর্বটিসহ নানান সবজি। ইতোমধ্যে এসব সবজি ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু আকষ্মিক ভারী বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ও পাহাড় ধসে কৃষকের সবকিছুই ছারখার করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইয়াংছা থেকে গয়ালমারা এলাকা পর্যন্ত। এখানে প্রাথমিকভাবে সরকারীভাবে ক্ষতির পরিমাণ মাত্র ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে উপজেলায় ৫ শতাধিক কৃষকের প্রাথমিক সরকারি ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৩০ হেক্টর জমির ফসল। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস। কিন্তু বেসরকারী হিসেব মতে এসব এলাকায় সাড়ে ৩০০শ কৃষকের প্রায় ২০০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া পৌরসভা, লামা সদর, গজালিয়া, ফাইতং, রুপসীপাড়া ও সরই ইউনিয়নে ২৫০ হেক্টর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরজমিন পরিদর্শনে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁশখাইল্লা ঝিরি মুখের সবজি চাষি নুরুল আবচার জানান, দুই একর জমিতে শসা, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, বেগুনসহ বিভিন্ন রকমারি সবজির আবাদ করেন তিনি। এতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এসব সবজি তুলে বাজারে নিয়ে যাওয়ার আগেই বৃষ্টি ও ঢলের পানি সবকিছু ছারখার করে দিয়েছে। তিনি আরো জানান, ঋণ, স্বর্ণ বন্ধক ও হাওলাতি টাকা নিয়ে সবজি চাষ করেন তিনি। আরেক চাষী নুরুল কবির প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে ৪ একর জমিতে বর্ষাকালীন সবজি চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ফসল বাজারে নেওয়ার সময়ও হয়েছিল। কিন্তু বৃৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এক টাকারও সবজি বিক্রি করতে পারেননি। ইয়াংছা এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অমর জিৎ দে জানান, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বøকের পাহাড় ও খালের দু’পাড়ে ব্যাপক হারে সবজি চাষ হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টিতে কৃষকের সবজি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি গাছও মরে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমার ব্লকে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হেক্টর ধরা হয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে তালিকা করা হলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলেও জানান তিনি। টানা বর্ষণে ইয়াংছা এলাকায় সবজি চাষের ব্যপক ক্ষতি হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আপ্রæচিং মার্মা জানায়, ‘আমার ওয়ার্ডের সিংহভাগ মানুষ ইয়াংছা খালের দু’পাড় ও পাহাড়ে সবজি ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব কৃষকরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ধান ও অন্য চাষাবাদ করে আসছেন। প্রথমবারের ফসল হানিতে কম করে হলেও সাড়ে তিনশ চাষীর প্রায় ২০০ হেক্টর জমির গ্রীস্মকালীন সবজি নস্ট হয়ে গেছে। এখন দেনার দায়ে কৃষকদের ভিটেবাড়ি ছাড়তে হবে মনে হচ্ছে। কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনাসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের দাবী জানিয়ে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাকের হোসেন মজুমদার জানান, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন ইয়াংছা ও বগাইছড়ি খাল বেষ্টিত। ইউনিয়নের সিংহভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। তাই বর্ষা মৌসুমে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সবজিচাষ হয় এখানে। পাহাড়ি ঢলের তান্ডবে সবজি চাষির এখন মাথায় হাত উঠেছে। সরকারিভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও কৃষকরা কিছুটা হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এ ব্যাপারে লামা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা সানজিদা বিনতে সালাম জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড় ধসে উপজেলায় কৃষকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।