পাশবিকতা চাপা দিতেই কী পরিকল্পিত হত্যাকান্ড

41

তুষার দেব

মাদ্রাসা পড়ুয়া কোমলমতি শিশু-কিশোরদের একের পর এক রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর ঘটনা রহস্যাবৃতই থেকে যাচ্ছে। পুলিশের তদন্তে এসব ঘটনার কোনও কিনারা মিলছে না। কোনও কোনও ঘটনার পর মাদ্রাসার শিক্ষক লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছেন কিংবা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, পাশবিকতার ঘটনা ধামাচাপা দিতেই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের পর কৌশলে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হচ্ছে। পুলিশ জানায়, সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে নয়টায় নগরীর মেহেদীবাগ দারুস শেফা তাহফিজুল মাদ্রাসার বাথরুম থেকে শাবিব শায়ান (৯) নামে এক মাদ্রাসা ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সে ওই মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এটিকে আত্মহত্যা দাবি করলেও রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার ওই মাদ্রাসা ছাত্রের স্বজনরা বলছেন, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দুরন্ত শিশুটি কোনওভাবেই আত্মহত্যা করতে পারে না। শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। শিশুটির বাবা ও তার আত্মীয় স্বজনরা এটিকে হত্যাকান্ড বলে অভিযোগ করে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।
নগর পুলিশের কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মরদেহের সুরতহাল বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা এটি তদন্ত করে দেখছেন। এক্ষেত্রে মরদেহের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা পেলে হয়তো মৃত্যুর প্রকৃত কারণ স্পষ্ট হবে। এছাড়া, সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজসহ আরও কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করে মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, কিছুদিন আগে শিশু একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয় শিশু শাবিব শায়ান। সেখানে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও জিতে নেয় শিশুটি। তারও আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ফার্নিচার মেলায়ও এই প্রতিভাবান শিশুটি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তার বাবা নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মশিউর রহমান চৌধুরী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার এই সুস্থ সবল ছেলে কখনওই আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি তার গলায় ও মুখে জখমের চিহ্ন দেখেছি। তারা বলছে, আমার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু সে কেন আত্মহত্যা করবে? আসলে তাকে নিপীড়নের পর হত্যা করা হয়েছে। মশিউর রহমানের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে শাবিব শায়ান ছিল সকলের বড় ছেলে। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায় হলেও পরিবারের সকলে নগরীর দামপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের মার্চে চট্টগ্রামে তিন দিনের ব্যবধানে দুই মাদ্রসাছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের লাশ ছিল গলাকাটা। অপরজনের লাশ উদ্ধার করা হয় শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত ও জখমের চিহ্নসহ। নগরীর পাঁচলাইশ ও জেলার বোয়ালখালী উপজেলায় মাদ্রাসা কম্পাউন্ড থেকে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। ওই দুই মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হলো, আরমান হোসেন (১৪) ও ইফতেখার মালেকুল মাশফি (৭)। এর মধ্যে আরমান ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে বলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও পরিবার বলছে, তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বোয়ালখালীতে মাশফি হত্যার ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এক বছরের দীর্ঘ তদন্তে কী কারণে বা কেন এই কোমলমতি শিশুদের হত্যা করা হলো, কারা এর সঙ্গে জড়িত- সেসব বিষয়ে পুলিশ কোনও কূলকিনারা করতে পারছে না। উদঘাটন হচ্ছে না রহস্য। পুলিশের দাবি, তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেককে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে করা মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়নসহ নানা নির্যাতনের অভিযোগ আমলে নিয়েই চলছে তদন্ত কার্যক্রম। গত বছরের ৫ মার্চ সকালে জেলার বোয়ালখালী উপজেলার চরনদ্বীপ ইউনিয়নে আল্লামা শাহ অছিয়র রহমান হেফজখানা ও এতিমখানার একটি পরিত্যক্ত কক্ষ থেকে গলায় ছুরি ঢুকানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ইফতেখার মালেকুল মাশফির লাশ। এ ঘটনার তিন দিন পর ওই বছরের ৮ মার্চ নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন পিলখানা এলাকার আলী বিন আবী তালিব মাদ্রাসা থেকে আরমান হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মাশফি হত্যা মামলায় মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক জাফর আহমেদকে গ্রেপ্তার করে দুই দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেও উল্লেখযোগ্য কোনও তথ্য পায়নি পুলিশ। দিনদুপুরে মাদ্রাসার ভেতর মাশফিকে কে বা কারা কী কারণে হত্যা করেছে তা আলোচনাও তাই থামেনি।
এদিকে, নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন পিলখানা এলাকার আলী বিন আবী তালিব মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র আরমান হোসেনের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় থানায় মামলা হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালের ৭ মার্চ বিকাল পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে আরমানকে অজ্ঞাত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা মাদ্রাসার ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করেছে। আশপাশের একাধিক শিশু বলেছে, আরমানকে কোনও এক হুজুর ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। তারা বাইরে থেকে তা দেখলেও ভয়ে পালিয়ে গেছে। আরমান কতিপয় হুজুরের যৌন লালসার শিকার হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে মামলার তদন্ত সেভাবে এগোয় নি।