পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধাগুলো দূর করতে হবে

136

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ী কি বাঙালি সকলেই দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করতে হবে।… শিক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সংঘাত নয়, শান্তি ও সমঝোতায় সকলকে নিয়ে চলতে চাই।’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র) শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আজ সেই শান্তি চুক্তির একুশ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। এই ২১ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল ১৪ বছর। প্রথম শাসনামলে এবং বর্তমান একটানা ১১ বছরে পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার আন্তরিকতার কোন তুলনা হয় না। তিনিই সক্ষম হয়েছেন সেখানকার বিরোধ মীমাংসা করতে। গড়ে তুলেছেন বাঙালি-পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সম্প্রীতি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এ চুক্তির পর কয়েকবছর যেতে না যেতে বহুধা বিভক্ত পার্বত্য জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীরা কিছুদিন পরপরই অশান্ত করে তুলছে পার্বত্য জনপদ। একসময় তাদের টার্গেট সরকার ও বাঙালি সাধারণ মানুষ হলেও কয়েকবছর ধরে যেন তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে লড়ছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ঘটছে প্রাণহানি। সূত্র জানায়, পার্বত্য অঞ্চলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নামে সক্রিয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেরাই পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকছে সবসময়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিয়ত চলছে বন্দুকযুদ্ধ ও অপহরণের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, সংস্কার (এম এন লারমা) গ্রুপের মধ্যে সংঘাত লেগেই রয়েছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও ঘটছে অস্ত্রধারীদের সংঘর্ষ। সূত্র জানায়, গত একবছরে তিন পার্বত্য জেলায় ১৮ জন নিহত, ২৬ জন আহত ও ৬৫ জনের অধিক অপহৃত হয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে বেশকয়েকবার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১৫ আগস্টের বন্দুকযুদ্ধ সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত ঘটনা। ওই দিন রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বরাদম এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধে ৫ জন নিহত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধের পর অভিযান চালিয়ে মেশিনগান, সাব মেশিনগান, চাইনিজ রাইফেল, এসএলআরসহ মোট ৮ আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৩৯ রাউন্ড বিভিন্ন অস্ত্রের গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। শান্তিচুক্তি পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিভিন্ন সময় বন্দুকযুদ্ধ হলেও এত বেশি প্রাণহানি এবং এত ভারী অস্ত্র উদ্ধার এই প্রথম। এই ঘটনা তাই আমাদের ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করছে। এরপর গত স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনেও তারা নানা বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংগঠিত করেছে।
আমরা জানি, পার্বত্য শান্তি চুক্তির আওতায় সে সময়কার বিচ্ছিন্নতাবাদীশান্তি বাহিনীর দুই হাজার সশস্ত্র কর্মী অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অবসান ঘটে অব্যাহত রক্তপাতের। সন্দেহ নেই, দীর্ঘদিন চলা সংঘাতময় পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির এই ঘটনা সমকালীন বিশ্ব পটভূমিতে একটি অনন্য ঘটনা। তৎকালীন সরকারেরও একটি অনেক বড় অর্জন। সেদিন এ চুক্তি স্বাক্ষর না হলে আজকের পরিস্থিতি কী হতো তা কল্পনা করাও কঠিন। আজ সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নেই একথা যেমন ঠিক, তেমনি পাহাড়ে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ কথাও পুরোপুরি বলা যাবে না। সম্প্রতি ঘটনাসমূহ প্রমাণ করছে, এখনো এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের দিকে সব সময় বন্দুক তাক করে থাকছে। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদে অপহরণ, রক্তাক্ত সংঘর্ষ, জমি দখলের খবর। চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির অভিযোগ পার্বত্য শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয় বলেই পাহাড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ বন্ধ হচ্ছে না। সমিতির দাবি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন। অন্যদিকে সরকার বলছে, চুক্তি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে ৮০ ভাগ বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। এটা সত্য যে, এ ধরনের চুক্তি বাস্তবায়ন রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে পার্বত্য অশান্তির মূলে যে বড় সমস্যাগুলো রয়েছে যেমন ভূমি বিরোধ- এ বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশা রয়েছে চুক্তির পক্ষের লোকজনের। অন্যদিকে চুক্তির বিরোধীরা এই সুযোগে অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব আরো উস্কে দিচ্ছে, সন্ত্রাস নৈরাজ্য চালাচ্ছে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশসহ আরো সেসব সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল, অশান্তি-সংঘাত-সহিংসতা সেই সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আঞ্চলিক গ্রুপগুলোর সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে এর সুফল দৃশ্যমান করতে হবে পার্বত্যবাসীর কাছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীল ভূমিকা দরকার পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় নেতৃত্বেরও।