পার্বত্য শান্তিচুক্তি : জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিলমোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ

29

মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে রাণী পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যতা ও জাতিগত বৈচিত্র্যতার জন্য এ অঞ্চল দেশের মানুষের কাছে অতি আকর্ষনীয়। দেরশর এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ অঞ্চল বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি ৩(তিন) পার্বত্যজেলার সমন্বয়ে গঠিত। যার আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক শোভামÐিত এ জনপদ আমার অতি প্রিয় ও স্বপ্নের ভূবন। ব্রিটিশ শাসনে শেষভাগে আমার পিতা এ জনপদকে জীবিকার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। এ সুবাদে পারিবারিকভাবে দক্ষিণ বান্দরবানের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাথে ব্যবসায়িক কর্মকাÐ ও কৃষি কার্যের মাধ্যমে আন্ত:সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। বাবা দীর্ঘকাল পার্বত্য এলাকার উৎপাদিত কার্পাস তুলাসহ বিবিধ কৃষিপণ্য চট্টগ্রামস্থ বাণিজ্যিক কেন্দ্র খাতুনগঞ্জে সরবরাহ করতেন। অন্য দিকে প্রজাতন্ত্রের একজন সেবক হিসেবে দীর্ঘ একযুগ এ জনপদে সরকারি চাকরি করার সুযোগ হয়েছে। ফলে পার্বত্য এলাকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, সামাজিক বৈচিত্র্যতা ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বেশ পরিচিত।
বাংলাদেশ একটি বহুজাতির, বহুভাষার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৩ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। যথা: বম, চাক, চাকমা, খুমী, খ্যাং, লুসাই, মারমা, ¤্রাে, মুরং, পাংখু, রাখাইন, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা। ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য এলাকায় ১৮৬০ সালে প্রশাসনিক ইউনিট স্থাপনের লক্ষ্যে একজন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগ করে। যার সদর দপ্তর ছিল রাঙ্গামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায়। তদকালে এ এলাকায় স্থানীয় শাসন ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু ছিল চাকমা রাজা। ব্রিটিশ সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং চাকমা রাজার কর্তৃত্ব খর্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে। সার্কেলগুলো হলো চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেল।
ব্রিটিশ শাসন আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতে মূল ভূখন্ডের বহির্ভূত এলাকা হিসে গণ্য ছিল। তথাপী ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য এলাকার শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ১৯০০ সালের ৬ জানুয়ারি ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং গধহঁধষ জারী করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনবিধি হিসেবে পরিচিত এ ম্যনুয়েল পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স¦াতন্ত্র্য ও তাদের ভূমির অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত। এ আইনে জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রচলিত আইন, রীতি, পদ্ধতি ও রেওয়াজসমূহ প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ আইনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সার্কেল প্রধান হিসেবে ‘রাজা’ মৌজা প্রধান হিসেবে ‘হেডম্যান’ ও পাড়া প্রধান হিসেবে ‘কারবারী’ নিয়োগ হয়ে আসছে। তারা স্থানীয়ভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করে আসছে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা। পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূল ভূখÐ বলে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং গধহঁধষ অনুসারে স্থানীয় শাসন কার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত অটুট রাখে। একই সাথে সরকার পার্বত্য এলাকায় বিবিধ উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যেমন সরকার ১৯৬২ সালে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন। ফলে হাজার হাজার পাহাড়ী জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়।
একটি বৈষম্যহীন, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকারের এক অনন্য দলিল। এ সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের সমঅধিকারের বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণ পরিষদের অধিবেশনে নির্দলীয় সদস্য শ্রী মানবেন্দ্র লারমা আঞ্চলিক স্বায়তশাসন ও জাতিসত্তার স্বীকৃতি দাবি করেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬(২) উল্লেখ আছে “বাংলাদেশের নাগরিকগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি হিসেবে গণ্য”। সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ মতে “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবে”।
তথাপী পার্বত্য এলাকায় সাধারণ পাহাড়ী, রাজ পরিবার ও তাদের প্রতিনিধির মাঝামাঝি সামন্তবাদ বিরোধী শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠে। যার সাংগঠনিক নেতৃত্ব এগিয়ে আসেন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমা, যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, ভবতোষ দেওয়ান, অমিয় সেন চাকমা প্রমুখ। এ সকল শিক্ষিত পাহাড়ী নাগরিকগণ ১৯৭২ সালের ১৬ মে গড়ে তোলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ নামক এক সংগঠন। এ সংগঠনের পক্ষে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট দাবি পেশ করা হয়। দাবি সমুহ ছিল: পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, ১৯৭২ সাল হতে আগত শরণার্থীদের প্রত্যাহার, কাপ্তাই বাধে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্মূল্যায়ন, উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও তদারকী পাহাড়ীদের উপর ন্যস্তকরণ। দাবিসমূহ আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে সমিতির বিশেষ শাখা হিসেবে ‘শান্তি বাহিনী’ গড়ে তোলা হয়।
কালের পরিক্রমায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং নিকটবর্তী স্থানীয় (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জেলার) কিছসংখ্যকু মানুষ পরস্পরিক প্রয়োজনে আন্ত:সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বা অঞ্চলভিত্তিক জনসংখ্যার সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে সমতল হতে আগত মানুষের অবস্থান, কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন,অভিবাসীদের স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান বিষয়ে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষেভের সূত্রপাত হয়। এ পাহাড়ী ব্যক্তিরা স্বাধীনতার পর হতে সংগবদ্ধ হয়ে সভা, সমাবেশসহ বিবিধ পন্থায় প্রতিবাদ শুরু করে । যেকোন বৈধ প্রতিবাদ একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এতে স্থানীয়ভাবে জন অসন্তোষ দেখা দেয়।
যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতি সত্তসমূহ এবং অ-উপজাতীয় জনগণ বসবাস কওে আসছে। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫ লক্ষ ৮৭ হাজর জন। অ-উপজাতিয়দের মধ্যে ৪৮ ভাগ মুসলমান এবং বাকীরা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। পার্বত্য এলাকার দীর্ঘকালের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান এবং ভৌগোলিক উন্নয়ন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিতকরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। বর্ণিত কমিটি পার্বত্য অঞ্চলের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ, প্রতিবাদী সংগঠন ও বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনাক্রমে সম্মত সিদ্ধানে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। এ পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জাতিসত্ত ও সকল ধর্ম-বর্ণেও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান ও অধিকার সুপ্রতিষ্ঠায় সম্পাদিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি।
শান্তিকামী ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর উপস্থিতিতে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে খাগড়াছড়িতে ঐতিহাসিক শান্তি চুুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ শান্তিচুক্তির মূল দর্শন সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখÐতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন। পার্বত্য অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এ চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য। ৭২ দফা সম্বলিত এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন পার্বত্য চট্টগাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ জনাব আবুল হাসনাত আব্দুল্লা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষে সভাপতি জনাব জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় লারমা। এ ঐতিহাসিক চুক্তির বিশেষত্ব হলো: পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা এবং এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করা। রাষ্ট্রের সমন্বিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গতিশীলকতা আনায়ন করা।
কোন প্রকার সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করে পারস্পরিক সমঝোথার মাধ্যমে সম্পাদিত এ শান্তিচুক্তি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পাদিত এ চুক্তি রাষ্ট্রীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। এ চুক্তির ফলে পার্বত্য এলাকার ধর্ম, জাতি, অ-বাঙালি ও নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থার অবসান ঘঠেছে। ব্যপক পরিসরে বৃদ্ধি পাচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাÐ। এখন পার্বত্য এলাকার সর্বত্র উন্নয়নের ছোয়া। রাষ্ট্র কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর নয়। বরং রাষ্ট্র সকল নাগরিকের ও সকল সম্প্রদায়ের। পার্বত্য শান্তি যার একটি অন্যতম প্রামাণ্য দলিল। পার্বত্য শান্তিচুক্তি হোক জাতীয় ঐক্য্য ও সম্প্রীতির দলিল। অনগ্রসর পার্বত্যবাসীর উন্নয়নে শান্তিচুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হোক আজকের অঙ্গীকার।

লেখক : সহকারী পরিচালক সমাজসেবা অধিদফতর
বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম