পার্বত্য তিন অঞ্চলে তিনদিনের বৈসাবি উৎসব শুরু

69

রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান প্রতিনিধি

দেশের পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়িদের ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে তিন দিনের বৈসাবি উৎসব। গতকাল মঙ্গলবার থেকে এ উৎসব শুরু হয়। প্রথমদিন পালিত হয়েছে ফুলবিজু। চাকমা রীতি ও প্রথা অনুযায়ী ফুলবিজুর দিন ভোরে নদী, হ্রদ বা পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্ণা জলে ফুল ভাসিয়ে শুভ সূচনা ঘটে তিন দিনের বৈসাবি উৎসবের।
রাঙামাটিতে সকালে রাজবন বিহার ঘাটে বিজু উদযাপন কমিটি, পুলিশের পলওয়েল পার্ক ঘাটে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন হিলর ভালেদী ও হিলর প্রোডাকশনসহ বিভিন্ন সংগঠন কেন্দ্রিক পাহাড়ি তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়েছে। যার মধ্য দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে অতীতের দুঃখ, কষ্ট, গøানি দূর করে নতুন বছরে অনাবিল সুখ, শান্তি, মঙ্গলময় ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ।
আজ (বুধবার) পালিত হবে মূলবিজু। এদিন ঘরে ঘরে যার যা সাধ ও সাধ্যমতো ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সব অতিথিদের আপ্যায়নের আয়োজন চলবে।
প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বাংলাবর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষ্যে তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসবটি পালন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ। এটিকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, রাখাইনরা সাংক্রান এবং অহমিয়া জনগোষ্ঠী বিহু নামে উদযাপন করে থাকে। আর ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু শব্দের আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’র সংক্ষেপ রুপ দেওয়া হয়েছে। ১২-১৪ এপ্রিল পাহাড়িদের ঘরে ঘরে মূল উৎসব পালিত হয়। পাশাপাশি উৎসবটিকে ঘিরে পালিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নাচগান, খেলাধুলাসহ নানা বর্ণাঢ্য কর্মসূচি।
রাঙামাটি রাজবাড়ী ঘাটে বৈসাবি উদ্্যাপন কমিটির উদ্যোগে গ্রামের তরুণ-তরুণীরা ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে তিন দিনের উৎসবের সূচনা করা হয়। মঙ্গলবার সকালে গর্জনতলীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবের উদ্বোধন করেন রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রæ চৌধুরী। এসময় জেলা পরিষদ সদস্য বিপুল ত্রিপুরাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অরেকটি রাজবাড়ী ঘাটে বৈসাবি উৎযাপন কমিটির উদ্যোগে ফুল বিজুর উদ্বোধন করেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। এ সময় সাবেক উপসচিব প্রকৃত রঞ্জন চাকমা, রাঙামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমা বিনতে আমিনসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বৈসাবি উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর এই তিনদিনে আনন্দ উৎসবে মেতে থাকবে পার্বত্য অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। আজ (বুধবার) মূল বিজুর উৎসব পালন করবে পাহাড়ের জনগোষ্ঠী। ঐতিহ্যবাহী পাঁচন রান্না করে অতিথি আপ্পায়নের মধ্যে দিয়ে মূল বিজুর আনুষ্ঠানিকতা। আগামী ১৬ এপ্রিল সাংগ্রাই জলোৎসবের মধ্যে দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।
খাগড়াছড়ি জেলায় ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীর পারে ফুল দিয়ে পূজার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ফুল বিজুকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে নদীর পাড়গুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈসাবি উৎসব উপভোগ করতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক এখন খাগড়াছড়িতে অবস্থান করছে।
পাহাড়ি সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এবং ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হল্লা করে ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদী-খালে ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে। এছাড়া ফুল দিয়ে ঘরের প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়।
আজ (বুধবার) মূল বিজু আর পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ত্রিপুরাদের ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। একই সাথে আগামীকাল ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু, বিযুমা, বিচিকাতাল। ফুল বিজু, মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্টতায় এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাইং উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা ও জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে বর্ষবরণের র‌্যালী।
ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের নাম একত্র করে বৈসাবি শব্দটির উৎপত্তি। পাশিপাশি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩ ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও অবস্থানকে বৈচিত্রময় করে করে তুলতে প্রতিবছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে।
বান্দরবানে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু করেছে নানা কর্মসূচি। সকলের মঙ্গল কামনায় সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজু পালন করলো চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর তীরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের তরুণ তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে শুরু করে ফুল বিজু উৎসবের। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়েরর শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে বান্দরবানে শুরু করে বর্ষবরণের আয়োজন। এই ‘ফুল বিজু’র মাধ্যমেই গঙ্গাদেবীর মঙ্গল কামনায় ও পুরানো বছরের সব দুঃখ, গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় তারা।
তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের তরুণীরা জানান- সকলে যেন সুখে শান্তিতে থাকে এজন্যে আমরা নদীতে ফুল ভাসাই। এদিনটা আমাদের জন্য খুবই খুশির দিন। গত দুই বছর আমরা করোনার জন্য ফুল ভাসাতে পারিনি এবারে ফুল বিজু পালন করতে পেরে বেশি খুশি লাগছে। আয়োজক কমিটির সুবল চাকমা বলেন- আমরা তিনদিন ব্যাপী বিজু উৎসব পালন করবো আজ (মঙ্গলবার) হচ্ছে প্রথমদিন। আজ থেকে প্রতিদিন নানা উৎসব পালন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রতিবছরই পার্বত্য এলাকা বান্দরবানে মারমা সম্প্রদায় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উদযাপন করে মাহা সাংগ্রাইং উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মধ্যে মারমা জনগোষ্ঠী সাংগ্রাইং নামে এ উৎসব পালন করে। করোনার কারণে গত দুই বছর উৎসব পালন করতে না পারলেও এই বছর পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরের আগমণের পূর্বে তাই বান্দরবানের মারমা সম্প্রদায় নতুন বর্ষকে বরণ করে নিতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
প্রতিবছর নানা আয়োজনে মারমা সম্প্রদায় এই বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকে আর মারমা ভাষায় এই উৎসবকে বলা হয় সাংগ্রাইং উৎসব। মূলত তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানেই মারমা সম্প্রদায়ের জনসংখ্য বেশি, তাই বান্দরবানে মূলত এই সাংগ্রাইকে ঘিরে কয়েকদিন চলে বর্র্ণিল আয়োজন।
সাংগ্রাইং উৎসব উপলক্ষে বাজার করতে আসা মংশৈ হ্লা মার্মা জানান, প্রতিবছরের মত এবারও আমাদের সামনে নতুন বছর আসছে, তাই বাজার করতে এসেছি। পরিবার পরিজনের জন্য নতুন পোশাক ক্রয় করবো আর আনন্দের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে উদযাপন করবো।
মাহা সাংগ্রাইং উৎসব উপলক্ষে বাজারে আসা মং থোয়াই সিং মারমা জানান, বাজারে এসেছি মা বাবার জন্য নতুন পোশাক ক্রয় করবো আর নতুন বছরের নতুন নতুন জিনিস-পত্র দিয়ে বাড়ি ঘর সাজাবো। বাংলা নববর্ষ আর আমাদের সাংগ্রাই, তাই ৪ দিন আমরা বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই নতুন বছরকে স্বাগত জানাবো।
সাংগ্রাইং উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি থেওয়াং (হ্লাএমং) জানান, নানা আয়োজনে ১৩ই এপ্রিল সকালে বান্দরবান রাজার মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হবে সাংগ্রাই উৎসবের আর শোভাযাত্রা শেষে বয়ঃজ্যেষ্ঠ পূজা। ১৪ই এপ্রিল সকালে মিনি ম্যারাথন দৌঁড়, বিকালে পবিত্র বুদ্ধ মূর্তি স্নান, রাতব্যাপী পিঠা তৈরি উৎসব, ১৫ই এপ্রিল বিকালে বান্দরবানের উজানীপাড়া সাঙ্গু নদীর চরে মৈত্রী পানি বর্ষণ, ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহণ ও সবশেষে ১৬ই এপ্রিল সন্ধ্যায় বিহারে বিহারে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী এই সাংগ্রাই উৎসবের।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আখতার জানান, বান্দরবান একটি শান্তপ্রিয় শহর। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে এই এলাকার পরিবেশ সবসময় শান্ত থাকে। আমরা নববর্ষকে কেন্দ্র করে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি এবং অনুষ্ঠানস্থলের আশেপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।