পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা

450

বাবুল কান্তি দাশ

শিক্ষা হতে হবে তিনটি ‘ঐ’ এর সমন্বয়। তিনটি ঐ মানে- Hand, Head, Heart. . হাতের শিক্ষা বা বাস্তব কর্ম শিক্ষা, মাথার শিক্ষা বা বুদ্ধিবৃত্তির শিক্ষা এবং হৃদয়বৃত্তির শিক্ষা।হৃদয়ের শিক্ষা মানে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, অহিংসা প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটানো। সহজ কথায় হাতের মাধ্যমে কর্মযোগ,মাথার মাধ্যমে জ্ঞানযোগ আর হৃদয়ের মাধ্যমে ভক্তিযোগের সাধনা করার মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিক্ষা লাভ করা যায়।
অত্যন্ত জটিল বিষয়গুলোকে গল্প, উপন্যাসের মত সহজ সরল বোধগম্য করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপস্হাপন করাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাঠ্যপুস্তক হতে হবে সহজ, সরল। অল্পের মধ্যে তা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের করে তুলতে হবে প্রত্যয়-সন্দীপী। শেখানটা চলবে সহজ স্বাভাবিক ভাবে। কোন কৃত্রিম আড়ষ্টতা সৃষ্টি করে নয়। প্রকৃতির সংস্পর্শে রেখে গল্পচ্ছলে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। আর এমনি ভাবে করতে পারলে জ্ঞানপিপাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেশার মত পেয়ে বসবে।২০২৩ থেকে নোতুন যে শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে তা সেই লক্ষ্য রেখে। শিক্ষা পরিবারের সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা নতুন শিক্ষাক্রম কার্যকর বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকবে।মেধাবী সমাজ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে নোতুন শিক্ষাক্রম কার্য্যকর ভূমিকা রাখবে বলে অভিজ্ঞ মহলের আশা। শিক্ষকদের হতে হবে ত্রিকালদর্শী। এক একটা শিক্ষার্থীকে ধাত বুঝে পোষণ দিয়ে চরম বিকাশের কোটায় পৌঁছে দিতে হবে।বিদ্যালয় যেমন ঠিক করতে হবে,পরিবেশ ও প্রতিটি পরিবারকেও তেমনি শিক্ষার উপযোগী করে তুলতে হবে গল্পে, কথায়, কাজে, বাড়ীতে, মাঠে, খেলায়, ধূলায়, হাসিতে, গানে, পিতা-মাতার সং¯্রবে পারিপার্শ্বিকের কাছে সবভাবে শিক্ষার স্পর্শ দিতে হবে। তখনই হবে প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষার্থীরা তখন বোঝা নয়, সম্পদ হয়ে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করবে। আমার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, অবকাঠামো, সামর্থ্য সবকিছু পরখ করে তদনুগ শিক্ষাকে সাঁজাতে হবে। কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর যদি শিক্ষা নির্ভর করে তাহলে তা বিপদ ডেকে আনবে অতি নিশ্চয়।টিকে থাকার তাগিদ জীব- মাত্রেরই আছে।যে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য যেমন দৈহিক ও মানসিক গঠন প্রয়োজন, তেমনতর দৈহিক ও মানসিক গঠন উদ্ভিন্ন করে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় সব অর্জন, বিসর্জনে পর্যবসিত হবে। আমাদের শুদ্ধ চেতনায় শিক্ষাকে নিয়ে যুগপযোগী করে তা বাস্তবায়নে কোন চালাকি না রেখে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে যে কোন চালাকি, সমঝোতা প্রজন্ম ধ্বংস করে দিবে। আজকের ভোগবাদী সমাজ যে ধারায় এগুচ্ছে তা কখনো দেশ ও জাতির কল্যান বয়ে আনবে না। শিক্ষাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিই। তা নিয়ে ভাবি। দেশের প্রায় সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা তা নিরাকরণে শুদ্ধ চেতনায় মনোনিবেশ পূর্বক অগ্রণী হয়। দেশ ও জাতিকে রক্ষা করি। প্রাচীন যুগে চীনারা যখন শান্তিতে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিল তখন তারা গ্রেট ওয়াল নির্মাণ করল। চীনারা ভেবেছিল এটার উচ্চতার জন্য কেউ টপকে তাদের আক্রমণ করতে পারবে না। গ্রেট ওয়াল নির্মাণের প্রথম একশো বছরের মধ্যেই চীনারা তিন বার আক্রান্ত হয়। আশ্চর্যের বিষয় কোনোবারই আক্রমণকারীদের দেওয়াল টপকানোর বা ভাঙার প্রয়োজন হয় নাই। কারণ প্রত্যেক বারই আক্রমণকারীরা দেওয়াল পাহারারত রক্ষীদের উৎকোচ দিয়ে সামনের গেট দিয়ে ঢুকে গেছে।
চীনারা অনেক পরিশ্রম করে মজবুত দেওয়াল তৈরি করেছিল। কিন্তু তারা দেওয়াল পাহারা দেওয়া রক্ষীদের চরিত্র মজবুত করার জন্য কোন পরিশ্রমই করেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে দেওয়াল মজবুত করার থেকে চরিত্র মজবুত করার প্রশ্নটিই আগে আসে শুধু দেওয়াল মজবুত করার ফলাফল শূন্য। তাই অনেক আগেই একজন প্রাচ‍্যদেশীয় দার্শনিক বলে গেছেন তুমি যদি কোন সভ্যতা ধ্বংস করতে চাও তাহলে তিনটি কাজ করো- ১. যে জাতিকে পদানত করতে চাও তার পারিবারিক গঠন আগে ধ্বংস কর। পারিবারিক গঠন ধ্বংস করতে হলে সংসারে মায়ের ভূমিকাকে খাটো করে দেখাও যাতে সে গৃহবধূ পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। ২. শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দাও। এটা করতে হলে শিক্ষককে প্রাধান্য দিও না। সমাজে তার অবস্থান নিচু করে দেখাও যাতে তার ছাত্ররাই তাকে উপহাস করে। ৩. তরুণ সমাজ যেন অনুসরণ করার মত কোন রোল মডেল না পায়। তাই তাদের জ্ঞানীদের নানা ভাবে অপমান কর। রোল মডেলদের নামে অসংখ্য মিথ্যা কুৎসা রটাও যাতে তরুণ সমাজ তাদের অনুসরণ করতে দ্বিধাবোধ করে। পারিবারিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুসমন্বয়ে আদর্শ সন্তান গড়ে উঠে।পরিবার হলো একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে পরিবারের সদস্যরা প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ও মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। পরিবারকে বলা হয় ‘জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার’। পরিবার হলো ‘শাশ্বত বিদ্যালয়’, ‘চিরন্তন মাতৃসদন’। মানুষ তার সামগ্রিক জীবনে যত জ্ঞান, শিক্ষা, ঐশ্বর্য অর্জন করে তার সূচনাই হয় পরিবার থেকে। মায়ের কোলে হয় শিশুশিক্ষার হাতেখড়ি। তাই সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও তেমন আদর্শ ধারণ ও লালন করে থাকে। একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করে শিক্ষিত হওয়া যায় কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা না পেলে জ্ঞানের পূর্ণতা আসে না। তখন অর্জিত সব জ্ঞান-গরিমাই ¤øান হয়ে যায়। কেননা সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালনপালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।বর্তমান সমাজে পরিবারের দায়িত্ববোধ কমে যাওয়ায় এবং পারিবারিক গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কারণে সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি আমাদের মূল্যায়ন, আকর্ষণ দিনদিন কমে যাচ্ছে। যার ফলে বাবা-মা-ভাই-বোন কেউই কারো প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা যথাযথ দায়িত্ববোধ অনুভব করছে না। বস্তুবাদী এ সমাজের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা আজ বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বাবা-মা উভয়েই চাকরি ও অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছেন না। ফলে ছেলেমেয়েরা অভিভাবক বা বড়দের পরোয়া করছে না। গ্রাম্য ভাষায় একটা ধারণা প্রচলিত আছে, পরিবার আদর্শ হলে সেই পরিবারের সন্তানও আদর্শ হয়ে গড়ে উঠবে। বস্তুত একটি শিশু যখন নিজ থেকেই হাত-পা নাড়তে শেখে, তখন থেকেই মূলত সে পরিবারের কাছ থেকে শিখতে শুরু করে। আর তখন থেকেই তার সামনে বাবা-মা তথা বড়দের আচার-আচরণ ও বিভিন্ন বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে চলা উচিত। বাড়ন্ত শিশুকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভালো-মন্দ বিষয়ে অবহিত করতে হয়। তার সঙ্গে নরম সুরে, মার্জিত আচরণে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতে হয়। শিশুদের মন-মানসিকতা থাকে খুবই কোমল, তাই খুব সহজেই যে কোনো বিষয় তারা শিখে নিতে পারে। বড়দের কর্তব্য, আদর-স্নেহের মাধ্যমে বুঝিয়ে তাদের যে কোনো বদঅভ্যাস থেকে বিরত রাখা। বাবা-মাকে অবশ্যই সন্তানের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে পরম মমতায়। সন্তান কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশছে ঠিক মতো বাড়ী ফিরছে কিনা তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। তাহলে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বা আচরণ থেকে সন্তান এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখা যাবে। এর সাথে খেয়াল রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়।বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদকালীন যে শিক্ষা আমরা গ্রহণ করি, তাই-ই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সুশৃঙ্খল নিরাপদ এবং শিক্ষাবান্ধব হওয়া বাঞ্ছনীয়। নতুবা কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা আরোপিত কিছু যা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে এমনতরো কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে সকল ধরনের মতের ঊর্ধ্বে উঠে। কোনোভাবেই শিক্ষার সুশৃঙ্খল পরিবেশ যেন বিঘিœত না হয়। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে তথা শিক্ষার নীতি ও পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আসলে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটা পূরণ করে তা ভেবে দেখার বিষয়। প্রকৃত শিক্ষা শুধুমাত্র কিছু তথ্যগত জ্ঞান নয়, প্রকৃত শিক্ষা হলো মানুষের মনোজাগতিক উৎকর্ষ সাধন। আজকাল অনেকেই উপার্জনমুখী বা আয়বর্ধক শিক্ষাকে শিক্ষা বলে ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত থাকেন। শুধু উপার্জনের উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা অর্জন করা হয় তাকে খÐিত শিক্ষা বলা যায়। যা পরিপূর্ণ শিক্ষা নয়। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য আসলে তা নয়। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা অধর্মের কর্ম। শিক্ষা হলো এমন এক পূত পবিত্র ঐশী শক্তি, যা মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে। মনের আঁধার দূর করে হৃদয়কে স্বর্গীয় আলোকে উদ্ভাসিত করে। হৃদয়ের কুপ্রবৃত্তিগুলোকে পরাভূত করে সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগ্রত করে মানুষের মানবিক গুণাবলিগুলোর পরিস্ফুটন ঘটিয়ে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জীবন-জগৎ ও মহাজাগতিক শক্তির মাঝে যে ঐক্যতান বয়ে চলেছে, শিক্ষা তা উপলব্ধিতে সহায়তা করে। মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ চিন্তার চেতনা তৈরি করে।যে শিক্ষা শিক্ষার্থীর মাঝে উন্নত চিন্তা এবং উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটায় না, প্রকৃতপক্ষে সেই শিক্ষা অনর্থক। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায়, ‘কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগের ফলে যদি বস্তুটির অবস্থানের পরিবর্তন (সরণ) হয়, তাহলে প্রযুক্ত বল এবং বলের দিকে বস্তুর অতিক্রান্ত দূরত্বের গুণফলকে কাজ বলে।’ কাজের সাথে বল, সময় এবং দূরত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। যদি বল প্রয়োগ করার পর নির্দিষ্ট সময় অন্তে অতিক্রান্ত দূরত্ব শূন্য হয় তাহলে তার কাজের পরিমাণও শূন্য। ঠিক তেমনই ১৭/১৮ বছর ধরে লেখাপড়া (বল প্রয়োগ) করে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তে যদি শিক্ষার্থীর মাঝে উন্নত চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ না ঘটে, তাহলে তার শিক্ষার পরিমাণটাও শূন্য। আর আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ এই অন্তসার শূন্য শিক্ষার পিছনেই ছুটছে প্রতিনিয়ত। সন্তান বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া শিখে একজন ভাল মানুষ হবে, আজকাল এমন ভাবনা ভাবেন এমন অভিভাবক এর সংখ্যা খুবই নগন্য। এখন ভাল মানুষ হওয়ার থেকে ভাল সনদপত্রের গুরুত্ব অনেক বেশী। ফলশ্রæতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে নাকি সব থেকে লাভজনক ব্যবসা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবসা। এখন যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সবথেকে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী এ+ পায়, সেই প্রতিষ্ঠানকে সবথেকে ভাল প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। শিক্ষা যদি তাদের মাঝে দূরদর্শিতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হয় তাহলে তা জীবনের ঊর্ধ্বায়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না।আর তা যদি যথার্থ হয় তাহলে জীবনে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে হবে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যদি যথাযথ হয় তাহলে কোনভাবেই তাদের বেকার থাকতে হবে না।অর্জিত জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগ এবং কর্ম কুশল প্রচেষ্টা সন্তানের কাঙ্খিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। যদি একজন কৃষকের সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী না পায়, তাহলে বেকার না থেকে তার অর্জিত জ্ঞান কৃষিতে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। যদি কোন ব্যবসায়ীর সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী না পায়, তাহলে তার অর্জিত জ্ঞান ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। যদি কোন চাকুরীজীবীর সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী না পায়, তাহলে তার উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করার সুযোগ আছে। আর যদি দিনমজুরের সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী না পায় তাহলে? প্রকৃতপক্ষে এরাই শিক্ষিত, কারণ কোন দিনমজুরের সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী না পেলেও বেকার না থেকে প্রয়োজনে নিজের কর্মক্ষেত্র নিজেই তৈরী করে নেয়। শিক্ষিত ব্যক্তির হৃদয়ের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে সমাজ আলোকিত হয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অন্ধকার বিরাজমান শিক্ষার পরশে তা দূরীভূত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে কি তা হচ্ছে? এখন ঘরে ঘরে এমএ বিএ পাশ করা মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ক্রমবর্ধমানহারে বেড়েই চলেছে। শিক্ষাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার কোনো প্রভাবই অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সমাজে পড়ছে না। কেন পড়ছে না? পড়ছে না এ কারণে যে, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পূরণ করতে পারছে না। ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের অসংখ্য মনীষীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না অথচ তাদের দেয়া জ্ঞানভাÐার অধ্যয়ন করেই আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট অর্জন করি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল কারোরই সার্টিফিকেট নেই। কিন্তু তাদের রচনা অধ্যয়ন করে আমরা পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি।
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে কলেজ ত্যাগ করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি গল্পকার সাদত হাসান মান্টো তিনবার মেট্রিক ফেল করে চতুর্থবার পাস করে। এমনকি তিনি মেট্রিকে উর্দুতেও ফেল মেরেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে তিনিই পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন উর্দু ভাষার বিখ্যাত গল্পকার। এরকম পৃথিবী বিখ্যাত অনেক মনীষী সনদপত্র ব্যতিরেক নিজের দ্যূতি ছড়াতে সক্ষম হয়েছেন। এধরনের প্রতিভা ব্যতিক্রম। সেই প্রতিভা তথা মহামনীষীদের জীবন কর্ম অনুশীলন অনুধ্যানের মাধ্যমে নিজ নিজ প্রতিভার বিকাশ ও সমৃদ্ধায়ণে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিষ্ঠানের চারদিক শিক্ষা বান্ধব সুশৃঙ্খল হয় এবং কুপ্রবৃত্তি মানসজাত চাপ প্রয়োগ থেকে মুক্ত থাকে তাহলে পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের আদলটাই পাল্টে যাবে।বহুধাবিভক্ত শিক্ষাকে একইধারায় নেওয়া, সরকারি বেসরকারি বৈষম্য নিরসন জরুরি। সন্তানদের সামনে আদর্শ উপস্থাপন করি, আদর্শানুগ জীবন চলনায় প্রবৃত্ত হই। আদর্শ পরিবার গঠনে মনোযোগী হই শিক্ষায় যথাযথ মনোনিবেশ করে দেশপ্রেমিক সুনাগরিক তৈরিতে ব্রতী হই এবং সুশৃঙ্খল স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখি।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক