পারিবারিক অশান্তিতে খুনোখুনি বাড়ছে

21

তুষার দেব

প্রিয়জনের হাতও এখন আর নিরাপদ থাকছে না। পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও পারিবারিক অশান্তির জেরে খুনোখুনির মত ভয়ঙ্কর ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভরসার মানুষ এক পর্যায়ে হয়ে যাচ্ছে নির্মম হন্তারক। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কাছে হেরে যাচ্ছে সহনশীলতা ও মূল্যবোধ। কখনও স্বামীকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হচ্ছেন স্ত্রী, কখনওবা স্ত্রীকে নৃশংসভাবে খুনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারাগারের বাসিন্দা হচ্ছেন স্বামী। এতে পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
এ ধরনের খুনোখুনির ঘটনা সভ্য সমাজে মেনে নেয়া যায় না উল্লেখ করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আ স ম মাহতাব উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, পারিবারিক অশান্তিকে এমন করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সমীচিন নয়। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে নৈতিকতা ও সহনশীলতার অভাব এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই এমন অনাকাক্সিক্ষত অপরাধের ঘটনা ঘটছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ থেকে এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ জন্ম নিচ্ছে। এসব ঘটনা প্রচলিত পুলিশি ব্যবস্থায় নিরাময়যোগ্য নয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সহনশীলতার চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হানাহানি বা খুনোখুনি কখনও অশান্তির সমাধান হতে পারে না।
সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, মানুষ জন্মগতভাবে মানুষ হিসাবে পরিচিতি পেলেও প্রকৃত অর্থে মনুষ্যত্ব অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু। যথার্থ জীবনাদর্শের অভাবে আমাদের সমাজে পরিবারগুলো এখন ভোগবিলাসী ও পরশ্রীকাতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে স্বার্থপরতা এবং যেনতেনভাবে অর্থকড়ি ও সম্পদ অর্জনই শেষকথা বলে মনে করছে মানুষ। অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ পরিচালিত হচ্ছে সীমাহীন স্বার্থের মোহে। ন্যূনতম নৈতিকতার চর্চাও এখানে অনুপস্থিত। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ লোপ পাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে পারিবারিক হত্যাকান্ড, পাশবিকতা ও ভেজালপ্রবণতাসহ সামাজিক অপরাধগুলো মামুলি ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার এই সমাজে মানুষ কেউ কারও বন্ধু হওয়ার বদলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একে অপরের ক্ষতিসাধনে মগ্ন হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন পারিবারিক অস্থিরতা ও অধঃপতনমুখী সমাজব্যবস্থা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবলমাত্র গত এক মাসের মধ্যেই নগরীতে অন্তত তিনটি পারিবারিক হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় স্ত্রী এবং একটি ঘটনায় স্বামী হত্যার শিকার হয়েছে। পুলিশ তিনটি ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। সময়ের ব্যবধানে এ ধরনের নৃশংসতা বেড়েই চলেছে। গত ১৭ নভেম্বর নগরীর কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা হাওলাদার বাড়ি এলাকায় পারিবারিক কলহের জেরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে শাহিন আক্তার (২৫) নামে এক গৃহবধূকে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন তার স্বামী মোহাম্মদ নকিব (২৪) কে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। নিহত গৃহবধূ শাহিন কর্ণফুলী থানাধীন ছাবের আহমদ চেয়ারম্যান বাড়ির পাশে হাওলাদার বাড়ির মৃত মুজিবুর রহমানের মেয়ে। এ ঘটনায় নিহতের মা ছেনুয়ারা বেগম বাদি হয়ে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নকিবকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। কারান্তরীণ নকিব ভোলা জেলার তজমুদ্দিন থানার পলোয়ান খাসেরহাটস্থ লামছি শম্ভুপাড়ার মোহাম্মদ শরীফের ছেলে।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, নিহত শাহিন আক্তারের সাথে ২০১৮ সালে মোহাম্মদ মুরাদ নামে একজনের প্রথম বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে দাম্পত্য কলহ লেগে ছিল। বিয়ের দেড়বছর পর প্রথম স্বামী মুরাদকে তালাক দেন শাহিন। তাদের ঘরে রাইসা আক্তার নামে এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তালাকের পর শাহিন চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের সেনের টেক এলাকায় এসে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে জীবিকা চালাতেন। মোহাম্মদ নকিবও ওই পোশাক কারখানায় চাকরি করার সুবাদে দু’জনের পরিচয় হয়। ছয় মাস আগে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তারা নগরীতে বসবাস করলেও পরে কর্ণফুলী থানাধীন চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের জকিরের কলোনিতে বাসা ভাড়া নেন। বিয়ের কিছুদিন পর থেকে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। মাস দুয়েক আগে তারা বাসা বদল করে শাহিনের পৈত্রিক ভাড়াঘরে উঠেন। গত ১৭ নভেম্বর রাতে স্বামী-স্ত্রী বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে স্বামী নকিব ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করে শাহিনকে হত্যা করে। শাহিন বেঁচে আছেন ভেবে তার মা ও স্থানীয় লোকজন তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহিনকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন শাহিনের স্বামী নকিবকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এ ঘটনার তিনদিন আগে গত ১৪ নভেম্বর রাতে বাকলিয়ায় স্বামী আব্দুর শুক্কুর ওরফে সোহেলকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ তার স্ত্রী লিজা আক্তার (২৩) কে গ্রেপ্তার করে। ওই দম্পতি দুই সন্তান নিয়ে বাকলিয়ার হাটখোলায় একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। পুলিশ জানায়, ঘটনার পর সোহেলের বাবা আব্দুস সালাম বাকলিয়া থানায় একটি মামলা করেন। সেখানে পারিবারিক কলহের জেরে সোহেলকে ‘শ্বাসরোধ করে হত্যা’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এতে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিয়ে হয় সোহেল ও লিজার। বিয়ের পর থেকেই পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে দু’জনের ঝগড়া হত। লিজার ‘চাপে’ দু’বছর আগে হাটখোলায় আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করেন তারা। সুরতহালে মৃতদেহের গলায় ও বুকে কালো দাগ দেখা গেছে। ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর নগরীর পতেঙ্গার কাটগড় এলাকায় ঘটে আরেক নৃশংস খুনের ঘটনা। জানা গেছে, দু’মাস আগে প্রেম করে মামতো বোন আতিয়া আক্তারকে বিয়ে করেন সোহানুর রহমান (২২)। কিন্তু পরকীয়া নিয়ে স্বামীকে সন্দেহ শুরু করেন আতিয়া। সেই সন্দেহ কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য, খুন হন স্বামীর হাতে। তাকে খুন করে ড্রামে ভরে লাশ লুকিয়ে রাখেন সোহানুর। পরে তিন বন্ধুর সহযোগিতায় সুযোগ বুঝে ড্রামভর্তি লাশ সড়কের পাশে রেখে পালিয়ে যান। তবে পালিয়ে বাঁচতে পারেননি পুলিশের হাত থেকে। গত ২০ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে সোহানুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি বগুড়ার সারিয়াকান্দির বাসিন্দা। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিন বন্ধু মোহাম্মদ রুবেল, মোহাম্মদ আশিক ও অটোরিকশা চালক লিটনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায়, বিয়ের পর থেকে স্বামী সোহানুরের পরকীয়া নিয়ে সন্দেহ করেন স্ত্রী আতিয়া। এ নিয়ে গত ১১ অক্টোবর দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হলে সোহানুর স্ত্রী আতিয়াকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরদিন সকালে সোহানুর তার বন্ধু রুবেল ও আশিককে বাসায় ডেকে আনে। তাদের সহযোগিতায় মরদেহ একটি প্লাস্টিকের ড্রামে ঢুকিয়ে তার কর্মস্থল পতেঙ্গার একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের গুদামে নিয়ে লুকিয়ে রাখেন। এর দুদিন পর গত ১৩ অক্টোবর রাতে গুদাম থেকে ড্রামভর্তি মরদেহ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে পতেঙ্গা কালী মন্দির এলাকায় নিয়ে গিয়ে সড়কের পাশে ফেলে দেয়। এজন্য অটোরিকশা চালক লিটনকে তিন হাজার টাকা দেন। এরপর সোহানুর কুমিল্লা পালিয়ে যান।