পানি আটকে ৪ দিন ধরে অচল বিমানবন্দর সড়ক

111

কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই এগিয়ে চলেছে বিমানবন্দর সড়ক। একদিনের বৃষ্টিতেই সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় সড়কের উপর পানি। রাস্তা থেকে একশ গজ দূরে নদীতে পানি নামতে পারছিল না। কারণ পানি চলাচলের শাখা নদীর উপর ১২ বছর আগে থেকে দেয়াল নির্মাণ করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে রুবি সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ। সড়কে পানি জমে থাকায় ফলে গত চারদিন ধরে দীর্ঘ যানজটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরজীবন। এমনকি সড়ক থেকে পানি সরাতে দুইদিন যাবত পাম্প চালিয়েও সুফল মেলেনি। লাগাতার বৃষ্টিতে আবারও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছিল। সর্বশেষ গতকাল মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন উদ্যোগ নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সমন্বয়ে দেওয়ালটি ভাঙা হয়। এতে সড়ক থেকে পানিও সরছে এবং যান চলাচলেও স্বাভাবিকতা ফিরছে বলে জানা গেছে।
জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সবধরনের বাধা বিপত্তি অতিক্রমে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
এদিকে গত সোমবার থেকে বৃষ্টির কারণে সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির সাথে সাথে সেই পানির পরিমাণ আরও বাড়ছিল। কারণ সড়কের সাথে সংযুক্ত নালার পানি নদীতে নামতে পারছিল না। জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর একটি শাখা নদী সড়কের সাথে সংযুক্ত। যেটার মাধ্যমে নালার পানি নদীতে পতিত হত। ২০০৭ সালে ওই এলাকার একটি খাল দখল করে কর্ণফুলী ইপিজেড। পরে সাবেক মেয়র মঞ্জুর আলমের আমলে রুবি সিমেন্ট শাখা খালটি দখলে নিয়ে দেয়াল নির্মাণ করে। এতে করে পানি নামার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অল্প বৃষ্টিতে সড়কে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। লাগাতার চারদিনের বৃষ্টিতে স্থবির হয়ে পড়ে বিমানবন্দর সড়ক। ফলে গত চারদিন ধরে অনেক যাত্রী ফ্লাইট মিস করেছেন। যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি ফ্লাইট বিলম্বে যাত্রা করেছে। কয়েকটি ফ্লাইট বাতিলও হয়েছে। গত দুদিন ধরে হজ ফ্লাইটের যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে উঠে। যানজটে আটকা পড়ে বেশ কয়েকজন হজযাত্রী ফ্লাইট মিস করেছেন। অনেক হজযাত্রী ও বিমানযাত্রী জীবন বাজি রেখে উত্তাল নদীতে সদরঘাট এবং অভয়মিত্র ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন। শুধু বিমানযাত্রী নন, যানজটে পুরো এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এলাকার হাজার হাজার মানুষ নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছতে পারেননি। স্কুল-কলেজেও উপস্থিত হতে পারেনি অনেক ছাত্রছাত্রী। অন্যদিকে দীর্ঘ যানজটের কারণে ব্যাহত হয়েছে আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। যানজটের কারণে ঠিক সময়ে রপ্তানি পণ্য বিশেষ করে তৈরি পোষাকের কন্টেইনার জাহাজীকরণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অর্ডার বাতিল হওয়ার শঙ্কায় ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
বিমানবন্দর সড়কে অচলাবস্থার তৃতীয়দিন বুধবার দেশে ফিরেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওইদিন রাতেই পাম্প দিয়ে সড়ক থেকে পানি সরানোর নির্দেশ দেন প্রকৌশল বিভাগকে। গত বুধবার রাতে পাম্প চালিয়ে সড়ক থেকে পানি সরানো হয়। তবে গতকাল ভোরে প্রবল বৃষ্টিতে আবারও পানি জমে যথারীতি যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে মেয়রের নির্দেশে সকাল থেকে ওই এলাকায় কাজ করছিল সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ। এই বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, গতকাল সকাল থেকেই আমি ওখানে ছিলাম। মেয়রের নির্দেশনা ছিল এই অচলাবস্থা থেকে যেকোনোভাবে নগরবাসীকে মুক্ত করা। কিন্তু সড়ক থেকে পানি নামার শাখা খালটিতে রুবি সিমেন্ট দেয়াল নির্মাণ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। ফলে রাস্তা থেকে পানি সরানো যাচ্ছিল না।
তিনি আরও বলেন, সরেজমিনে গিয়ে দেখি সড়কের উপর জমা পানিতে স্রোত রয়েছে। কিন্তু রুবি সিমেন্টের ভিতর শাখা খালে কোনো স্রোত নেই। এই খালটিকে অনেকটা মৃত বানিয়ে রাখা হয়েছে। ৩০ ফিটের প্রস্থ কমে হয়েছে ৮ফিট। এই খালের সাথে নালার সংযোগ স্থাপনে বারবার বাধা দিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরে মেয়র মহোদয় পুলিশ প্রশাসন ও সিডিএ মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নকারী সেনাবাহিনীর সাথে সমন্বয় করেন। সর্বশেষ সিডিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দেয়ালটি ভাঙার নির্দেশ দিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেয়ালটি ভাঙা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পানি সরানোর জন্য খালের সাথে সংযোগ নালা স্থাপন করা হচ্ছে। ফলে সড়কে আর পানি জমবে না। যান চলাচলও স্বাভাবিক হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, সিডিএ’র স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ অভিযানে সহযোগিতা করেন ইপিজেড থানা পুলিশসহ সেনাবাহিনীর ৩৪ বিগ্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা। গতকাল বিকাল থেকে চলা এই উচ্ছেদ অভিযান সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বলে জানিয়েছেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল আবু সাদাত মোহাম্মদ তানভীর। তিনি জানান, জলাবদ্ধতা নিরসরনের জন্য খাল পাড়ে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনার পাশাপাশি রুবি সিমেন্টের বিশাল দেওয়ালটিও কম দায়ী না। এ দেওয়ালের কারণে সিমেন্ট ক্রসিং এলাকার পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল। অনেক বাধা-বিপত্তির পরও গতকাল সিডিএর ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সহযোগিতায় আমাদের ৩৪ বিগ্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা তা গুড়িয়ে দিয়েছে। আজ শুক্রবার দেওয়ালের অবশিষ্ট অংশ ভাঙা হবে।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সাবেক মেয়রের আমলে ড্রেনের জায়গাগুলো দখলে নেয় রুবি সিমেন্ট। তারা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে আইনকে বৃঙ্গাঙ্গুলি দেখায়। আমি ইংল্যান্ড থেকে ঢাকায় নেমেই ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলাম পাম্প দিয়ে পানি সরানোর জন্য। সারারাত প্রকৌশলীরা কষ্ট করে পানি সরিয়েছেন। কিন্তু সকালের বৃষ্টিতে আবারও পানি জমে যায়। আমাদের প্রকৌশলীরা যখন দেয়াল ভেঙে খালের সাথে ড্রেন সংযুক্ত করার কথা বলছিলেন, তখন তারা আমার সাথে যোগাযোগ করে রবিবার পর্যন্ত সময় চান। আমি তাদের বলেছি, এখানে জনদুর্ভোগ হচ্ছে সময় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের মানুষকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছেন। সুতারাং এখানে ‘কম্প্রোমাইজ’ করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতা প্রকল্প যেহেতেু সিডিএ- সেনাবাহিনী বাস্তবায়ন করছে, তাই তাদের সাথে সমন্বয় করে দেয়ালটি ভাঙা হচ্ছে। আবার তারা যাতে জনদুর্ভোগের বিপরীতে গিয়ে পুলিশের সাহায্য না নিতে পারে,তাই পুলিশ কমিশনারকেও বিষয়টি অবহিত করে রেখেছি। আর খালের সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে প্রশস্ত ড্রেন।