পাকিস্তান সংকটের সুরাহা কিভাবে?

16

পূর্বদেশ ডেস্ক

যেন কোনো রুদ্ধশ্বাস ক্রিকেট ম্যাচের স্লগ ওভার। গত রোববার এমনই নাটকীয় টানটান উত্তেজনায় ভরে উঠল পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন। দেশটির নির্বাচিত সরকারের পতন যখন অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তখনই শেষ মুহূর্তে ম্যাচ বাঁচিয়ে নিলেন ১৯৯২ সালের ক্রিকেটে বিশ্বজয়ী পাকিস্তান দলের ক্যাপ্টেন। পাকিস্তানের সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবই খারিজ করে দিলেন ডেপুটি স্পিকার। এখানেই শেষ নয়। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইমরান খানের পরামর্শে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এই পরিস্থিতিতে পাক সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান অবমাননার অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় বিরোধীরা। এখন জানা যাচ্ছে, পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া বৈধ ছিল কিনা তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আজ মঙ্গলবার রায় দিতে পারেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভবিষ্যৎ এখন সুপ্রিম কোর্টের হাতে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) আবেদন গ্রহণ করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আদালত ডেপুটি স্পিকারের সিদ্ধান্ত খতিয়ে দেখবে। তবে ডেপুটি স্পিকারকে সাসপেন্ড করে দেয়ার আবেদন তিনি খারিজ করে দিয়েছেন।
তবে অতীতের মতো এবার সরাসরি সেনা অভ্যুত্থান দেখেনি পাকিস্তান। দেশজুড়ে প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও দেখা যায়নি সেনাবাহিনীর দাপাদাপি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানের বিদায় স্পষ্ট হতেই নতুন করে আলোচনায় চলে আসছে ‘পাক ফৌজের নেপথ্য ভূমিকা’।
সেনাবাহিনীর তরফে অবশ্য ইতিমধ্যেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, চলতি রাজনৈতিক টানাপড়েনের অংশীদার হবে না তারা। সেনাবাহিনীর ‘ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস’ (আইসিপিআর)-এর ডিরেক্টর মেজর জেনারেল বাবর ইফতিকার গতকাল সোমবার বলেন, স্পষ্ট ভাবে জানাচ্ছি, বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই।
ইমরান খান অভিযোগ করছেন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এই অনাস্থা ভোট আমেরিকানদের একটি চক্রান্ত, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এর আগে রোববার ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে একটি অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট হওয়ার কথা থাকলেও – যেই ভোটে তিনি শোচনীয় ভাবে পরাজিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল – পার্লামেন্টের স্পিকার কাসিম সুরি বিরোধী দলগুলোর জোটের অনাস্থা ভোট করার দাবি নাকচ করে দেন। পরে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন।
পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দায়িত্ব নেয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় মন্ত্রিসভা বাতিল করে দিয়েছেন। অনাস্থা ভোট আয়োজনের প্রক্রিয়াকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইমরান খান।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের উত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদের পুরোটা সময় দায়িত্বে থাকতে পারেননি।
রোববার মন্ত্রিসভা রদ হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইমরান খান আর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। তবে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ইমরান খানই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বিরোধী জোটের নেতা শাহবাজ শরিফকে এরই মধ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বাইরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি জানান এই পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকা হতে পারে।
তিনি জানান প্রধান বিচারপতির বিশেষ ক্ষমতা অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকা হবে কিনা। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিতে সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান কর্মকর্তারা রয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে গুলজারের নাম প্রস্তাব ইমরানের
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি গুলজার আহমেদকে মনোনীত করেছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম ডনের খবরে এই তথ্য জানানো হয়েছে। ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, পিটিআই-র কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রোববার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর পাকিস্তানে ইতোমধ্যে তত্ত¡াবধায়ক সরকার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন যদি তিন দিনের মধ্যে দেশটির দুই রাজনীতিক একমত হয়ে একজনের নাম সুপারিশ করতে না পারেন, তাহলে উভয়ই দুটি করে নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে দায়িত্বপ্রাপ্ত পার্লামেন্টারিয়ান কমিটিতে প্রেরণ করবেন।

আলোচনায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি শহবাজের
পাকিস্তানের সংবিধানের ২২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুচ্ছেদ ৫৮ এর অধীনে সংসদ বাতিল হয়ে গেলে দেশের প্রেসিডেন্ট তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার সাথে আলোচনা করে। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর জোট ও পিএমএল-এন নেতা শাহবাজ শরিফ জানিয়েছেন তিনি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আলোচনায় অংশ নেবেন না।
তিনি বলেছেন ‘সংবিধানের লঙ্ঘনকারীদের যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্তির আওতায় না আনা হচ্ছে’ ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আলোচনায় বসবেন না। ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনার সময় এ মন্তব্য করেন তিনি।

ইমরান গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহে দোষী
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহে’র অভিযোগ এনেছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সর্বোচ্চ নেতা নওয়াজ শরিফ। গতকাল সোমবার পাকিস্তানের দ্য ডন পত্রিকার প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজের জন্য ইমরান ও তার সহযোগী ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিহিত করেন নওয়াজ। তিনি বলেন, ইমরান একজন ক্ষমতাচ্ছন্ন ব্যক্তি, যিনি সংবিধানকে পদদলিত করেছেন।

ইমরানের অভ্যুত্থান বন্ধ করুন
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি গতকাল সোমবার ইমরান খানের অভ্যুত্থান বন্ধ ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দেশটির সুপ্রিম কোর্টকে একটি পূর্ণাঙ্গ আদালতের বেঞ্চ গঠন করার আহব্বান জানিয়েছেন। ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রোববার পার্লামেন্টে যা ঘটেছে তা সংবিধানের ভয়াবহ লঙ্ঘন। বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারির মতে, ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে একটি বৈধ পন্থা হলো অনাস্থা ভোট। ইমরান খান কেবলমাত্র তার অহংবোধের কারণে সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে অনাস্থা প্রক্রিয়াকে হত্যা করলেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্বাচিত হবেন
প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের তেমন নেই, বরং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার ঐক্যমতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন প্রেসিডেন্ট। অনুচ্ছেদ ২২৪ অনুযায়ী, বাতিল হয়ে যাওয়া সংসদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মধ্যে একজনকে নিয়োগের বিষয়ে ঐক্যমত্য হতে হবে। মন্ত্রিসভা রদ হওয়ার তিন দিনের মধ্যে এই নিয়োগ দিতে হবে।
নতুন নাম নির্ধারিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট সেই নাম অনুমোদন করবেন এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বে থাকবেন।
যদি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা – বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইমরান খান ও শাহবাজ শরিফ – একজন প্রার্থীর নামের বিষয়ে সম্মত হতে না পারেন, তাহলে এই দায়িত্ব একটি কমিটির ওপর বর্তাবে যেখানে ক্ষমতাসীন দলের চারজন ও বিরোধী দলের চারজন সদস্য থাকতে হবে।

ইমরানের সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন
পাকিস্তানে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়ে ভোটের সিদ্ধান্ত এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা রাজনীতিতে নেই।
পাকিস্তানে রোববার নাটকীয় পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়ে প্রেসিডেন্ট আরিফ ভোটের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। এরপরই বিষয়টি গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উমর বান্দিয়াল জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সব নির্দেশ খতিয়ে দেখতে পারে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই কথা বলেছেন। বর্তমান অবস্থা বলতে, অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দেয়া ও তারপর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়াই বুঝিয়ছেন মুখপাত্র। মামলার বিচার করছেন তিন বিচারপতির বেঞ্চ।
সংবাদপত্র ডন জানাচ্ছে, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের পর আইনজীবী আসাদ রহিম বলেছেন, আদালতের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়ার বিষয়টি ঝুলে রইল। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, দ্য ডন।