পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা কুমিরার প্রথম যুদ্ধে বিজয়ের কেতন উড়ালো বাঙালিরা

104

জামশেদ উদ্দীন

২৫ মার্চ কালো রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হতে এক বিশাল পাক কনভয় চট্টগ্রামের দিকে ধেয়ে আসে। এটি ছিল পাক ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-রেজিমেন্ট এবং ৮৮তম মর্টার ব্যাটারি। এ ব্রিগেডের কমান্ডিংয়ে ছিল পাক-বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইকবাল সফি। এসকল দানবসম পাক সেনাদের রুখতে জীবন-মরণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালি জওয়ানরা। সর্বপ্রথম স্বাধীনতাকামীরা প্রতিরোধ-যুদ্ধের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে শুভপুর ব্রিজটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়। তাতেও প্রতিরাধে সম্ভব না হলে সীতাকুন্ডের কুমিরা এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে প্রতিহত করা দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি নেয়া হয়। কুমিরা অঞ্চলটি অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালা ‘ইউ’ আকৃতি। পাহাড় ও সমুদ্র খুবই কাছাকাছি অবস্থিত। ট্রাঙ্করোড ও রেললাইন একশ’ গজের মধ্যে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি। মধ্যখানে হালকা হালকা গুটিকয়েক জনবসতি। সব মিলে এটি সম্মুখযুদ্ধের উপযুক্ত স্থান। এখানে পরপর তিনটি সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়।কুমিরার প্রথম সম্মুখযুদ্ধে ২৬ ও ২৭ মার্চ বাঙালি জওয়ানরা বিজয়ের কেতন উড়ায়। দ্বিতীয় যুদ্ধটিও সংঘটিত হয় ট্রাঙ্করোডের ১২ কি.মি. এলাকাজুড়ে। শেষ সম্মুখযুদ্ধটিও সংঘটিত হয় কুমিরায় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ডিসেম্বরে।
এদিকে ২৫ মার্চ রাতে ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের শতাধিক সৈনিক আহত অবস্থায় কুমিরা স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে অবস্থান নেয়। তাদের কেউ কেউ বিবস্ত্র অবস্থায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। থানা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ডা. আখতারুজ্জামান তাদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসেন। স্থানীয় সৈয়দ ফোরখ আহম্মদ, সৈয়দ হারেছ আহম্মদ, বাদশা ওসমান গণি, নাট্যকার কামাল কাদের, ছাত্রনেতা নাজিম উদ্দিন, কামাল উদ্দিনসহ শতাধিক স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতা জড়ো হন। তৎক্ষণাৎ স্থানীয় এলাকাবাসীর যা কিছু আছে, পুরনো কাপড়চোপড় ও খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে ওইরাতে হালিশহর ক্যাম্প থেকে আরো কিছু ইপিআর জওয়ান পালিয়ে আসে। তাদের জন্য খাবার ও সেল্টারের ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা ‘সোয়াত জাহাজ’ থেকে পাক বাহিনী রাতভর অস্ত্র খালাস করে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে মজুদ করতে থাকে। এর মধ্যে রাত ১টা কী দেড়টার দিকে অস্ত্র বোঝাই সোয়াত জাহাজ থেকে ৩ লরি অস্ত্রশস্ত্র কৌশলে স্বাধীনতাকামীরা কুমিরায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কুমিরা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র তাহের, নুরুল, জামালসহ উপস্থিত উৎসুক স্থানীয় যুবকরা রাতভর এসকল অস্ত্র খালাস করে এবং কিছু অস্ত্র ডা. আখতারুজ্জামানের বাসায়, কিছু কুমিরা স্কুল সংলগ্ন খালের ঝোপঝাড়ে মাটিতে পুঁতে রাখে।
ওই রাতেই ডা. আখতারুজ্জান, নাট্যকার কামাল কাদের, সৈয়দ ফোরক আহম্মদ ও সৈয়দ হারেছ আহম্মদের উপস্থিতি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক এমআর সিদ্দিকী’কে (এমএনএ) টেলিফোনে উদ্ভূত পরিস্থিতি অবহিত করেন। ২৫ মার্চ বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান খানিকটা অগ্রবর্তী হয়ে ৩২ কি.মি. অদুরে সীতাকুন্ডের মফস্বল শহর এলাকায় অবস্থা নেন। তিনি থানা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এখলাছ উদ্দিন ও ছাত্রনেতা এস এম হাসানের সাথে পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করে সদর সীতাকুন্ড পোস্ট অফিসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকেন। ওইসময় পোস্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন উপ-সহকারী পোস্ট মাস্টার পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য। একই সাথে জননেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা-বার্তা আসার বিষয় ওই পোস্ট মাস্টারকে অবহিত করেন। ওই রাতে পাক কনভয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রামের দিকে মার্চ করে। আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসনের নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামীরা রাতভর চেষ্টা চালিয়ে আংশিক বিকল করে দেয় ফেনী নদীর ওপর অবস্থিত শুভপুর ব্রিজটি। এর পূর্বে চট্টগ্রাম হতে মিরসরাই যাওয়ার পথে বাড়বকুন্ডস্থ চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের সম্মুখের ব্রিজটিও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়। ব্রিজটি বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। তখন থেকে ব্রিজটিতে ভারী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সকালের দিকে পাক কনভয় শুভপুরের ওই বিকল ব্রিজটি পুনরায় আংশিক মেরামত করে বিকল্প পথে চট্টগ্রাম অভিমুখে এগিয়ে আসে। ২৬ মার্চ সকাল ১১টার মধ্যে বারৈয়ারহাট এলাকায় পৌঁছে ওই পাক কনভয়।এ পাক কনভয়কে সর্বাত্মক প্রতিরোধের ডাক দিলেন সীতাকুন্ড থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মসজিদ্দা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এম এ মামুন, কুমিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফায়েল আহম্মদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রফিকসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আহম্মদ হোসেন সওদাগর। তাঁরা ছোট কুমিরা বাইক্কা পুলের পশ্চিমে লাগোয়া এবং নবাব মিয়া চৌধুরী বাড়ির সম্মুখের শতবর্ষী অশ্বত্থ বৃক্ষটি কেটে রোডে ব্যারিকেড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২৬ মার্চ ভোর থেকে গাছটি কাটা শুরু হয়। বিশাল আকৃতির এ অশ্বত্থ বৃক্ষটি পাঁচ জনের সমান বেড়। এটি কাটার জন্য বলিষ্ঠ দুই কাঠুরিয়াকে খুঁজে নেয়। তাদের একজন কুমিরা হিঙ্গুরী পাড়ার কোব্বাত আলীর ছেলে শাদু মিয়া প্রকাশ শদুবলি, অপর জন তাঁর সঙ্গি নুর হোসেন। তারা বৃক্ষটি কর্তন করতে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়। বিশেষ করে শদুবলি ব্রিটিশ ফেরা নাবিক। তিনি শারীরিক ভাবেও বেশ বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এবং ছোটখাটো একটি বিদ্যুতের খাম্বার মতো পুষ্ট পেশীর অধিকারী। এই স্বপ্নময়পুরুষ দীপ্তিময় চেতনা নিয়ে নির্ভয়ে কুড়ালের গুম্ গুম্ আঘাতে কেটেই চললেন। সঙ্গে উৎসুক গ্রামবাসীরাও যোগ দেন। দুপুর ২টার মধ্যেই গাছটা আঁছড়ে পড়ে! যেন শতাধিক হাতিসম একটি মরা নীলতিমি পড়ে আছে রাস্তাজুড়ে।
শদুবলি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি গাছটিতে বাসাবেঁধে থাকতো সাপ ও ঈগল। ঈগল কিয়ক্-কিয়ক্ ডেকে নীল আকাশে উড়ে যায় ডানা মেলে… বিষধর সাপ গাছের কুঠরিতে ডিমে তা দেয়…
২৬ মার্চ সকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খায়ের হোসেন ছুটিতে আসা এক বাঙালি জওয়ানকে ডেকে পাঠান। সুবেদার আবুল মুনছুর নামে ওই জওয়ানের বাড়ি মুরাদপুরের গুপ্তাখালি গ্রামে। তিনি দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতি দেখে কর্মস্থলের স্বপদে পাড়ি দেননি পশ্চিম পাকিস্তানে। সুবেদার আবুল মুনছুর ডা. আখতারুজ্জামানের বাসায় গিয়ে এসব অস্ত্র স্বচক্ষে দেখে। এদের মধ্যে শতাধিক রাইফেল, এসএমজি ও ২০-২৫ কার্টুন গোলার-বারুদ পৃথক করেন।ওইদিন সকাল ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া একজন ইপিআর জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম হতে কুমিরায় এসে পৌঁছেন। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে থানা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ডা. আখতারুজ্জামানসহ স্বাধীনতার পক্ষের আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। এক পর্যায়ে একটি মোটর সাইকেলযোগে সম্ভাব্য স্পটও দেখে নেন। কুমিল্লা থেকে ধেয়ে আসা ওই পাক কনভয় পথে পথে মুক্তিকামীদের অসংখ্য ছোট ছোট বাধা ডিঙিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে এগিয়ে আসতে থাকে। দীর্ঘ ১৩৫ কিলোমিটার পথ অনেকটা বিনা বাধায় অতিক্রম করে ২৬ মার্চ দুপুর ১টায় সীতাকুন্ডের দারোগাহাট এলাকায় পৌঁছে। স্থানীয় স্বাধীনতাকামী জনতা এদের প্রতিরোধে পথে পথে দেশিয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও লোহার রড জড়ো করে ট্রাঙ্ক রোডে অবস্থান নেন। সীতাকুন্ড থানা ছাত্রলীগ নেতা এস এম হাসান, এ কে এম সালাহউদ্দীন, শামছুল আলম টিপু ও তাহের হোসেন স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনে জড়ো হন এবং নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে হাতবোমা তৈরি করে স্বাধীনতাকামী সাধারণ-জনতাকে সরবরাহ করতে থাকে। দুপুর ২টার দিকে পাকসেনারা সীতাকুন্ড বাজার অতিক্রম করে। ওইসময় তারা নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে গিয়ে শেখপাড়াস্থ আহমদ ডাক্তারের বাড়ি’র কৃষক নুরুল হকের খোঁয়াড়ে বাঁধা ষাঁড় লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। এ ঘটনায় গুলি বিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ ষাঁড় দুটি মারা পড়ে! অবশ্য এ নিয়ে গ্রামের লোকজনের মধ্যে প্রচন্ড ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তাদের হাত থেকে নির্বোধ প্রাণীও রক্ষা পাচ্ছে না – সাধারণ জনগণের কাছে দিব্যি তা প্রতীয়মান হয়।
সীতাকুন্ড বাজারের ব্যবসায়ীরা বঙ্গবন্ধুর আহŸানে সকাল থেকে দোকানে-দোকানে কালো পতাকা উড়িয়ে দেয়! পাক সেনারা একপর্যায়ে বাজারটিতে নেমে ওইসব উড়ানো কালো পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ও পুড়িয়ে দিতে থাকে। বিক্ষুব্ধ সেনারা গোবিন্দ বিশ্বাসের বড় ছেলে মধু বিশ্বাসকে পতাকা উত্তোলনে এবং অমলেন্দু সেনকে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন ও বিক্রয়ের খোঁড়া অভিযোগে প্রকাশ্য-দিবালোকে রাস্তায় কানধরে ওঠবস করায়। আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এখলাছ উদ্দিনকে রাস্তায় ধরে এনে তৎক্ষণাৎ তাঁর চেম্বারের সামনে ড্রেনে ময়লা ও আবর্জনা পরিস্কার করার নির্দেশ দিয়ে চড়থাপ্পড় দিতে থাকে। সেনারা মাওলানা আব্দুল আওয়াল সিরাজিকেও অহেতুক পাছায় লাথি ও মুখে থাপ্পড় মারে। এদিকে পাক কনভয় প্রতিরোধে স্কুলছাত্র শামছুল আলম টিপু পেট্রলবোমা নিয়ে বাজারস্থ সিঅ্যানবি অফিস লাগোয়া আমগাছটির ডালে চড়ে বসে। ওই ছাত্রের উদ্দেশ্য ছিল পাক কনভয় অতিক্রমকালে পেট্রলবোমা ছুঁড়ে মারার। কিন্তু ওই কনভয়ের বিশালতা দেখে তৎক্ষণাৎ বোমা ছোঁড়া বন্ধ রাখে। আরো এক কি.মি. দক্ষিণে হাজিবাড়ি ও দোয়াজীপাড়া রাস্তার সামনে সকাল থেকে ট্রাঙ্ক রোডের পাশে অবস্থিত বিশাল আকৃতির ২টি শিমুল গাছ কেটে রোড ব্যারিকেড দিতে জোর প্রচেষ্টা চালায় স্বাধীনতাকামী জনতা। তাদের সাথে ছাত্রলীগ নেতা এসএম হাসান, আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ আলী ও ফোরকান যোগ দেন। তারা গাছ ২টি কেটে উঠে পারেনি। এর মধ্যে পাক কনভয় অতিসন্নিকটে এসে যাওযায় স্বাধীনতাকামীরা দ্রুত সরে পড়েন। আরো দেড় কি.মি. দক্ষিণে রহমতনগর এলাকায় স্থানীয় স্বাধীনতাকামী লোকজন দুপুর ১২টার দিকে অপর একটি অশ্বত্থবৃক্ষের ডালপালা কেটে রাস্তায় স্তুূপ করে যানচলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেয়।

তারা ট্রেন চলাচলও বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে একটি ট্রেন আটকা পড়ে। পরে ট্রেন চালকের অনুরোধে স্বাধীনতাকামীরা রেল লাইনের ব্যারিকেড সরিয়ে নেয়। কিন্তু ট্রাঙ্করোডে প্রতিবন্ধকতা থেকেই গেল। ঠিকই পাক কনভয় ওইপথে আটকা পড়ে। সেনারা ‘টপা-টপ’ নেমে ডালপালা ছুড়ে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
দুপুর সোয়া ২টায় বাড়বকুন্ডস্থ চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের সামনে বিধ্বস্থ ব্রিজটিতে আটকা পড়ে পাক কনভয়। পরে সেনারা ছনের আঁটি পুঁতে ধীরগতিতে ওইপথ পার হয়। সেনারা বাড়বকুÐ বাজারের দোকানের সামনে উড়ানো কালো পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ অবস্থায় স্বাধীনতাকামী যুবক বদিউল আলম প্রকাশ বাদশা মিয়া পাক কনভয় লক্ষ্য করে রাসায়নিক পদার্থভর্তি একটি বোতল ছুঁড়ে মারে। কিন্তু বোতলটিতে রাসায়নিক পদার্থের পরিবর্তে পানি ভর্তি যে ছিল জানতেন না। এতে করে পরিকল্পনা ভেস্তে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এতেও ওই বীর ক্ষান্ত হয়নি। এক পর্যায়ে দুই পাক সেনাকে জপটে ধরে! অতঃপর গুলি ও বেয়নট খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ওই স্বাধীনতাকামী বীরকে পাক সেনারা।
সীতাকুÐে শহিদ বদিউল আলম বাদশা হলেন পাক সেনাদের হাতে প্রাণহারনো প্রথম শহিদ। এ বীর বাড়বকুন্ড ইউপি’র মহাদেবপুর গ্রামের সাদাকাত উল্লাহর পুত্র। একই সঙ্গে ওই ইউপি’র নজির আহম্মদের পুত্র স্বাধীনতাকামী যুবক আতাউল হক গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর নাড়িভূঁড়ি বের হয়ে যায়। পরে এলাকাবাসী তাকে হাসপালে নিয়ে যায়।পাক সেনারা আরো চার কি. মি. অর্থাৎ ১৫০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে বিকেল আড়াইটার দিকে ছোট কুমিরা বাজারস্থ মসজিদ্দা স্কুলের সম্মুখে পৌঁছে। তারা রাস্তার ওপর স্তূপীকৃত পাথর ও গাছের গুঁড়ি সরিয়ে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে থাকে। বাজারের লোকজনও হঠাৎ পাক সেনাদের উপস্থিতি দেখে হতচকিত। তারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে দিগি¦দিক দৌঁড়তে থাকে। তাদের মধ্যে স্বাধীনতাকামী যুবক আবু তাহের সেনাদের দিকে পাথর ছুঁড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। এতে ওই স্বাধীনতাকামী যুবক গুলিবিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত অবস্থায়ও দৌড়ে বাজারসংলগ্ন এক বাড়িতে আশ্রয় নেয় ওই যুবক।
এর পূর্বে ওই পাক কনভয় বাজার অতিক্রমকালে অবাঙালি এক সিকিউরিটি অফিসার পাক সেনাদের থামিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি অবহিত করে। ওই সিকিউরিটি অফিসার অবাঙালিদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুল আহম্মদ জুট মিলে কর্মরত।
এদিকে রাস্তাজুড়ে পড়ে থাকা বিশাল আকৃতির অশ্বত্থ বৃক্ষটির সামনে পাক বহর আটকা পড়ে। দীর্ঘসময় ধরে অশ্বত্থ বৃক্ষটি সরানোর সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল সেনাদের। উপায়ন্তর না দেখে তারা অশ্বত্থ বৃক্ষটির উপর দিয়ে চালিয়ে দেয় গাড়ি বহর! এতে অস্ত্রভর্তি একটি লরি উল্টে বিস্ফোরিত হয়। এ প্রথম পাক বহরটি বড় ধরনের ধাক্কা খেল। স্বাধীনতাকামীরাও বড় ধরণের একটি ধাক্কা দিতে পেরেছে। তারা সকাল থেকে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে বৃক্ষটি কেটে রোডব্যারিকেড দেয়। শেষতক সৈন্যরা রাস্তার উত্তরপাশ লাগোয়া পতিত খাদে ছনের আঁটি পুঁতে বিকল্প সড়ক নির্মাণ করে। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে পাকিরা ওই বিপদজ্জনক পথে বহর পার করে। স্থানীয় আলম মিয়া চৌধুরী প্রকাশ আলম মেম্বার ওই ছনের মালিক। বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ওখানে স্তূপ দিয়ে রেখে। এ দুর্ঘটনায় পাকিরা আরো অধিকতর সতর্ক হয়ে উঠে। তারা বাইক্কারপুল পার হয়ে শাহ আলম চৌধুরীর ব্রিকফিল্ডে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি করে। তারা পুনরায় ম্যাপে এলাকাটির অবস্থান ও রাস্তাঘাট দেখে নেয়। সেনাদের এমন যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় – কী হতে চলেছে, কী হতে চলেছে। পাকিরা সম্ভবত রণকৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনে। তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে কিছু ট্রাঙ্করোড, কিছু রেললাইন ধরে এগিয়ে চললো।আরেকটু দক্ষিণে ট্রাঙ্করোডের বামঘেঁষেই যাদুর বিলটি অবস্থিত। যাদুর বিলের বুকচিরে চলে গেছে যক্ষা-সংক্রামকব্যাধি হাসপাতালের রোডটি। তারই তিনশ’ গজ দক্ষিণে স্টেশনরোড ও পরির রাস্তা। আরেকটু সামনে ট্রাঙ্ক রোডের বামে উম্মেদ আলী ফকির পুকুর। ওই পুকুরের পূর্ব ও দক্ষিণে কামাল ড্রাইভারের বাড়ি। ওই বাড়ির উত্তরে যাদুর বিল। যাদুর বিলের ওই ফাঁকা মাঠে ঐতিহাসিক কুমিরার প্রথম সম্মুখযুদ্ধ সংগঠিত হয়।সেবারও যাদুর বিলে শীতকালীন সব্জি চাষ করে কৃষকরা। টমেটো ও খিরার ফলনও ভালো হয়। ক্ষুধার্ত সেনারা কৃষকের টমেটো দুহাত ভরে কাঁচা কাঁচা চিবে-চিবে খাচ্ছে। ছোট কুমিরার বাজার থেকেও কয়েক টুকরি টমেটো গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। এ দৃশ্য দেখে কৃষকরা হতবাক। তারা রা-শব্দ করতেও সাহস পেলেন না। উল্টো প্রাণের ভয়ে দৌঁড়ে পালালেন।কুমিরা খালের উত্তরপ্রান্তে পাক কনভয়। দক্ষিণপ্রান্তে স্বল্পসংখ্যক স্বাধীনতাকামী আনসার, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু জওয়ান অবস্থান নেয়। তাদের সাথে গুল আহমদ জুট মিল থেকে পালিয়ে আসা আরো কয়েকজন স্বাধীনতাকামী আনসার তাদের সাথে যোগ দেয়। জোড়আমতল এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সেনা রাজা মিয়া ড্রাইভার, তরুণ বিমান সেনা রুস্তম আলী, আনসার কমান্ডার সৈয়দ হারেছ আহমদ, আনসার সদস্য নিয়ামত আলী, কোরবান আলী, জাফর আহমদ চৌধুরী, স্থানীয় জাহাঙ্গীর আলম, সোনাইছড়ি আওয়ামী লীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, তাঁর ছোট ভাই ইউসুফ আলী, ছাত্র কামাল উদ্দিন, ছাত্র গাজী সেকান্দর, নাজিম উদ্দিন, থানা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও সোনাইছড়ি আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. আখতারুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক সোলাইমান চৌধুরী, ইসলামাবাদী, মুজাফ্ফর উল্লাহ, বদিউল আলম সওদাগর, সেকান্দর সওদাগর, নুরুল আলম চৌধুরী, আনুমিয়া কন্ট্রকটার, তাজ মুহাম্মদসহ গ্রামবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাকামী বীর ইপিআর জওয়ানদের উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকে।
এদিকে শ্রমিক নেতা এটিএম নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে বাড়বকুন্ড এলাকায় পাক কনভয় প্রতিরোধ করার সকল চেষ্ট ক্ষীণ হয়ে উঠে। তিনি দ্রুত অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর আর্টিলারি বিভাগের সদস্য ছাবের আহম্মদ ও সন্দ্বীপের মনতাজুল করিম হাবিলদারকে নিয়ে একটি জিপ গাড়ি করে কুমিরায় অবস্থান নেন। ছাবের আহম্মদের কাছে ছিল একটি এলএমজি। যা থেকে প্রতি মিনিটে ২৮টি বুলেট বের হয়। এই অস্ত্র দিয়ে কুমিরার সম্মুখযুদ্ধে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
অপরদিকে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী ইপিআর জওয়ানরা কয়েকটি খোলা ট্রাকে করে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী হতে যুদ্ধের ময়দান কুমিরার দিকে অগ্রসর হন। তখন স্বাধীনতাকামী জনতা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ ধ্বনি ও করতালি দিয়ে তাঁদের সাহস-উৎসাহ দিতে থাকে। স্বাধীনতাকামী জওয়ানরা চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ইসহাক মিয়া এমপি ও সীতাকুন্ড থানা সংগ্রাম পরিষদের ডা. আখতারুজ্জামানের নিকট থেকে কয়েক ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে।প্রথমে স্বাধীনতাকামী ইপিআর জওয়ানরা কুমিরা বাজার লাগোয়া উত্তর পাশের খালের উপর মাথা উঁচু ব্রিজটির দক্ষিণ প্রান্তে শতবর্ষীয় তুলাগাছটির পাশঘেঁষে একটি, টিবি হাসপাতালের সম্মুখে ছয়টিলার ওপর একটি, ডালচালমিয়া মসজিদের পেছনে এবং কমিউনিটি সেল্টারে পৃথক আরো ২টি মেশিনগান উত্তরমুখী শত্রুর নিশানা বরাবর তাক করে।
তৎক্ষণাৎ পাক কনভয়ের রণকৌশল দেখে অগ্রবর্তী ডিফেন্স সরিয়ে স্বাধীনতাকামীরা দ্বিতীয় দফা উম্মেদ আলী ফকির মসজিদ পুকুরপাড়ে একটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্বপাশে কামাল ড্রাইভারের নির্মাণাধীন মাটিরগুদাম ঘরে একটি এবং রেললাইনের পূর্বপাশে চিরাপাহাড়ে অপর একটি ডিফেন্স স্থাপন করে। মূলত সোনাইছড়ির ঘোড়ামরা খালটি পেছনে রেখে উত্তর মুখি ডিফেন্স নেন স্বাধীনতাকামীরা। খালটি ফকিরহাট সংলগ্ন পাহাড় হতে নেমে ঘোড়ামরা ও জোড়ামতল গ্রামের বুকচিরে সন্দ্বীপ চ্যালেনে গিয়ে মিলিত হয়।
স্বাধীনতাকামীরা তড়িৎ রণকৌশলের কিছু পরিবর্তন আনে। তারা পাকসেনাদের ফাঁদে ফেলতে যাদুর বিল সংলগ্ন ট্রাঙ্করোডের উপর ডালপালা ও ইট দিয়ে হালকা ব্যারিকেড সৃষ্টি করে Ñ যেন পাক কনভয়ের গতিপথ কিছুটা থামানো যায় এবং ওই ব্যারিকেড সরাতে এলে মোক্ষম সময়টা বেছে নিতে পারে।যাদুর বিলই হলো কুমিরার প্রথম যুদ্ধের ময়দান। স্বাধীনতাকামীদের কমান্ডিংয়ে রয়েছেন তরুণ ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তিনি ফোর্সকে ৩টি প্লাটুনে ভাগ করেন। একজন সুবেদার, একজন নায়েক সুবেদার ও একজন হাবিলদারকে কমান্ডিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।
তৎক্ষণাৎ তারা দেখতে পেলেন সামনে নিশানা বরাবর শত্রæদের গাড়ি বহর ধেয়ে আসছে। উৎসুক জনতা এমন দৃশ্য উপভোগে আগেভাগে উঁচুস্থান বেছে নেন। কেউ কেউ গাছের ডালে ও বিল্ডিংয়ের ছাদে, আবার অনেকে পাহাড়ের টিলায় অবস্থান নেয়।মাগরিবের নামাজের পরপর অর্থাৎ সন্ধ্যা সাড়ে ৬-৭ টার দিকে পাকসেনারা স্টেশন রোড ও পরির রাস্তা ক্রস করতেই স্বাধীনতাকামী বীর জওয়ানদের মেশিনগান গর্জে উঠে। ঝড়ের গতিতে শত্রুর নিশানায় গুলি বিঁধতে থাকে। এমন ভয়াবহ অবস্থায়ও এক পাক ঊর্ধ্বতন সেনা ক্রলিং করে একা একা এগিয়ে যাচ্ছিল ধ্বংস করার মানসে। আর সেখানে রয়েছে এক দুঃসাহসী বাঙালি ইপিআর জওয়ান। উম্মেদ আলী ফকিরের পুকুরের উত্তর-পূর্বপাড় বেয়ে উঠতেই মেশিনগানটি তার ওপর তাক করা হলো। শত্রু নিশানায় নিখুঁত আঘাত হানে। চোখের পলকে ওই পাক হাবিলদার মেজর ঝাঁঝরা হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দিগি¦দিক ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পাক সেনারা। গোলাবারুদ ভর্তি দুটি লরি প্রচÐ শব্দে বিস্ফোরিত হয়। দাউ দাউ জ্বলে ওঠে আগুন। সারি-সারি পাকিদের লাশের স্তূপ। তার মধ্যে পাক কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জামিল ও এক লেফট্যানেন্ট কর্নেলসহ বিভিন্ন পদের ১৫২ জন সাধারণ সেনা মারা পড়ে এবং শহিদ হন স্বাধীনতাকামী বাঙালি বীর ১৪ জওয়ান।এর মধ্যে কিছু পাকসেনা মুক্তি ইপিআরদের অ্যাম্বুশ ভেদ করে দক্ষিণে ঘোড়ামরা রেলওয়ের ডিপোতে আটকা পড়ে এবং কিছু সেনা নিয়ে পাক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইকবাল শফি পাহাড়ের অরণ্যে লুকিয়ে পড়তে বাধ্য হন। থেমে গেল পাক কনভয়ের অগ্রযাত্রা! স্বল্পসংখ্যক বাঙালি ইপিআর জওয়ানদের হাতে ধরাশায়ী হল দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ওই পাক সেনাফৌজ।কুমিরার সম্মুখযুদ্ধের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া লিখেন, ২৪নং এফএফকে প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর মাত্র ১০২ জন সৈন্য নিয়ে এ অভিযান। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিমা হানাদার সৈন্য দলের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের মাত্র সম্বল একটি হেভি মেশিনগান, কয়েকটা লাইট মেশিন, বাকি সব রাইফেল। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পুরো একটা সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাওয়ার ঝুঁকি যে-কি বিরাট এবং তার পরিণাম যে-কি মারাত্মক হতে পারে, সেদিন তা উপলব্ধি করতে পারিনি। আগেই খবর পেয়েছিলাম, শত্রুবাহিনী ফেনীর কাছে শুভপুর ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে এসেছে। অতএব যত দ্রুত তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমার কথামত আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী ৫টা সাধারণ পরিবহন-ট্রাক এনে হাজির করল। তখন আমাদের ও জনসাধারণের মধ্যে প্রত্যেকেরই যেন একটা যুদ্ধংদেহী ভাব। তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন অনেক দিনের পুঞ্জীভূত বেদনা, বঞ্চনা, ক্ষোভ, আক্রোশ বিদ্রোহের আগুনে ফুঁসে উঠেছে, যা এক দুর্জয় সংগ্রামের ভেতর দিয়েই যেন স্ফুরিত হতে চায়। চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শোষণ ও অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে আজ সবাই যেন বদ্ধপরিকর।আমি আমার ক্ষুদ্র দলের ১০২ জন যোদ্ধাকে ৪টি ট্রাকে উঠালাম আর বাকি ট্রাকটিতে গুলির বাক্স উঠিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে চললাম। উদ্দেশ্য, এগানোর সাথে সাথে দু’পাশে এমন একটি উন্মুক্ত স্থান খুঁজে নেয়া যেখান থেকে শত্রুর ওপর সাফল্যের সাথে প্রচন্ড আঘাত হানা যায়। সেদিন আমাদের যাত্রাপথের দৃশ্য ভোলার নয়। রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে কল-কারখানার শ্রমিকই বেশি। মুখে তাদের নানান স্লোগান, আর তাদের সেই হাজারও কণ্ঠে আকাশ-বাতাস মুখরিত হচ্ছিল। তারা স্লোগান দিতে লাগল, ‘জয় বাংলা, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিন্দাবাদ, ইপিআর জিন্দাবাদ।’ এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈন্যদের কি দিয়ে এবং কিভাবে সাহায্য করতে পারবে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে।আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলো তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। এমন সময় একজন বুড়ো তার পথের পাশের দোকান থেকে তিন কার্টুন সিগারেট নিয়ে আমার হাতে তুলে দিল। বলল, স্যার, আমি গরিব মানুষ, কিছু দেয়ার মতো আমার ক্ষমতা নেই, এই নিন আমার দোকানের সিগারেট; আপনার জওয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন। বৃদ্ধের এই সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় আমার মন ভরে উঠলো। আর একজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এলো। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো। সন্ধ্যা কেবল ৬টা। আমরা কুমিরা পৌঁছে গেলাম। শত্রুকে বাধা দেয়ার জন্যে স্থানটি খুবই উপযুক্ত বিবেচিত হলো। পথের ডানে পাহাড় এবং বামদিকে আধমাইল দূরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধক, সেজন্য শত্রুকে এগুতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই তার পেছনে একটি খাল। ঐ খাল থেকে ৫০০-৬০০ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকের জায়গা বেছে নিই। খালটা কোনো পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাধা নয়। উদ্দেশ্য ছিল যদি বর্তমান পজিশন শত্রুরা আমাদের ছাড়তে বাধ্য করে তখন খালের পেছনে গিয়ে পজিশন নিতে পারব।এটা ছিল আমার বিকল্প পরিকল্পনা। এলাকাটি দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রতিরোধের (অ্যাম্বুশ) পরিকল্পনা তৈরি করে নিলাম। স্থির করলাম ১নং প্লাটুন ডানে, ২নং প্লাটুন বামে এবং ৩নং প্লাটুন আমার সঙ্গেই থাকবে। তিন প্লাটুনের কমান্ডারকে ডেকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নিতে নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী হেভি মেশিনগান ডান পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। স্বয়ং ইপিআর সুবেদার ভারি মেশিনগানটির সঙ্গে রইল। কারণ এই মেশিনগানটি ছিলো আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচাইতে বড় সম্পদ। আমি বাম দিকে কয়েকটি এলএমজি পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশমতো সবাই মাটিতে পজিশন নিল। পজিশনের স্থানটি অনেকটা ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির। অর্থাৎ ডানে-বামে এবং পেছনে আমাদের সৈনিক। যেদিক থেকে শত্রু এগিয়ে আসবে কেবল সেই সামনের দিকটাই খোলা। কুমিরা পৌঁছেই মোটর সাইকেলযোগে একটা লোককে পাঠিয়ে ছিলাম শত্রæর অগ্রগতি সম্পর্কে খবর নিতে। এর মধ্যে সে খবর নিয়ে এসছে যে, শত্রু আমাদের অবস্থানের আর বেশি দূরে নয়-তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আসছে। যে লোকটি পাঠিয়েছিলাম লোকটি পাঞ্জাবিদের কাছে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে আমাকে জানালো, পাঞ্জাবিদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কি যেন একটা কাঁধের ওপর, তাও কালো। তখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে, কারণ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সদস্যরাই কেবলমাত্র কালো বেল্ট, কালো ব্যাজ ও কালো র‌্যাংক ইউনিফর্ম ব্যবহার করে থাকে। আমাদের অবস্থানের ৭০-৮০ গজ দূরে একটি বড় গাছ ছিল। স্থানীয় লোকদের সাহায্য নিয়ে গাছের মোটা ডালটা কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলা হলো। গাছের ডাল দিয়ে রাস্তার ওপর সুন্দর একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি হয়ে গেল। রাস্তার আশপাশ থেকে কিছু ইট এনে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাখা হলো। সৈন্যদের জানিয়ে দেয়া হলো যে, শত্রু সৈন্য যখন ব্যারিকেড সাফ করার জন্য রাস্তায় নামবে এবং সাফ করার জন্য একত্রে জমা হবে তখন আমার ফায়ার করার সাথে সাথে সকলেই একযোগে শত্রæর ওপর গুলি ছোঁড়া শুরু করবে। বিশেষ করে ভারি মেশিনগান দিয়ে অবিরাম ফায়ার করবে।প্রায় এক ঘণ্টা শত্রুর প্রতীক্ষায় কেটে গেল। সন্ধ্যা তখন ৭টা। আমরা শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে আছি। আমাদের সামনে শত্রু বাহিনীর উপস্থিতি প্রায় আসন্ন বলে মনে হলো। দেখলাম শত্রুবাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ব্যারিকেড দেখে সামনের গাড়িগুলো থেমে গেল। কিছু সংখ্যক সিপাই গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। ওদের কেউ কেউ ইটগুলো তুলে দূরে ফেলে দিতে লাগলো। পেছনের গাড়িগুলোও তখন সামনে এগিয়ে এসে জমা হতে লাগল। সৈন্যরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত, তখন আমি ফায়ার করলাম। সাথে সাথে আমাদের ডান দিকের ভারি মেশিনগানটিও গর্জে উঠলো। শুরু হলো শত্রæ নিধন পালা। চারদিক থেকে গুলি আর গুলি। ভারি মেশিনগান থেকে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল ট্রেসার রাউন্ড বের হচ্ছে।আমাদের আকস্মিক আক্রমণে তারা তখন হতচকিত। ওদের সামনের কাতারের অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উহ্; সে কি ভয়াবহ দৃশ্য। তাদের কাতর আর্তনাদ আমাদের কানে আসছিল। আর যারা দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছিল তারাও মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুদের পেছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামাল দিয়ে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারি থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ শুরু করে দিল। এইভাবে কতক্ষণ চলল। কিন্তু বহু কষ্ট করেও শত্রুরা আমাদের ব্যূহ ভেদ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেল। আমাদের মেশিনগানটা ‘নিউট্রালাইজ’ করার জন্য তারা প্রচুর পরিমাণ আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করতে লাগল। কিন্তু আল্লাহ্র মেহেরবানীতে শত্রুর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। প্রায় ২ ঘণ্টা প্রাণপণ লড়েও শেষ পর্যন্ত দুই ট্রাক অস্ত্র ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হলো। … অর্থাৎ: ২৬ তারিখ রাতেই শত্রুবাহিনীর মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শত্রুবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল শাহপুর খান ও একজন লেফটেন্যান্টসহ বিভিন্ন পদের ১৫২ জন সাধারণ সৈন্য নিহত হয়। শত্রুদের দুই ট্রাক অ্যামুনিশন কব্জা করি, আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের ১৪ জন বীর সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন।’ (মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, পৃ. ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৪।)
গবেষক ও ইতিহাসবিদ আহমদ মমতাজ লেখেন, কুমিরা লড়াই ৩ দিন চলে। স্থল ও নৌ-পথে সাপোর্ট পেয়ে পাকবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়…মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলÑকুমিরার যুদ্ধে পাকিস্তানী জেনারেলদের আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে যায়; পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র-শ্রমিক সহ সাধারণ জনগণের মনোবলকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাড়িয়ে দেয়। কুমিরার এই সুদৃঢ় প্রতিরোধ-যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় একটি সফলতম যুদ্ধ। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, যাতে মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যন্ত উৎসাহী ও সাহসী করে তুলেছিল। (নাসিরুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিতÑমুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, পৃ. ৭৯০। প্রকাশকাল-২০১৩ ইং।)

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ফেলো, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ