পল্লির পরতে পরতে পল্লিকবির প্রেম

229

প্রত্যেক জাতির সচেতন শিল্পী তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক, সে বিবেচনায় গ্রামীণ বাঙালি সংস্কৃতিই কবি জসীম উদদীনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যমণি। তিনি মনে-প্রাণে অনুভব করেছেন পল্লির বেদনা, পল্লির সুখ। পল্লিকে দেখেছেন শিল্পদৃষ্টিতে।
“মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি?
মিছেই মোদের সুখদুখ দিয়ে তার সুখদুখ খুঁজি।
আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায়
যে লেখে বেদনা বেবুঝ বাঁশিতে কেমন দেখাব তায়?”
বাংলা কাব্যের প্রকৃতি যখন পল্লিজীবনের ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, তখন দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির ন্যায় কবি জসীম উদ্দীনের কাব্য আমাদের মুখকে ফিরিয়েছে পল্লির মাধুর্যময় রূপের দিকে। পল্লির পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিকে। তিনি জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এড়িয়ে আতœনিয়োগ করেন বাংলা কাব্যের শেকড়ের সন্ধানে। আর অত্যন্ত পরিপাটিভাবে গ্রামবাংলার সাদামাটা মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, সামাজিক সম্পর্ক, পারিবারিক মিল-বন্ধন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সুখ-দুখের কথাকে কাব্যিকসুরে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের অনন্য স্থানে।
তাঁর কবিতার সুর- লোকচিত্তের কথা। তাঁর কবিতার সুর- প্রকৃতিচিত্তের কথা।
চেকোশ্লাভাকিয়ার ভাষাবিদ প্রফেসর ড. দুশন জবভিতেল জসীম উদদীন সম্পর্কে বলেন- “জসীম উদদীনের বই যখন পড়ি তখনই তাতে নতুন নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করি। কবি জসীম উদ্দীন এইসব গ্রাম্য সাহিত্য ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, লম্বা লম্বা বছর ধরে নিজেই গ্রাম্য গান সংগ্রহ করেছিলেন। উনি কবি, বাল্যকাল থেকে কবিশিষ্যের মতো সবচেয়ে বড় কবির পায়ে বসেছিলেন যার নাম হচ্ছে জনসাধারণ।”
গেঁয়ো বাতাসের মতোই সুরলিত তাঁর কাব্যের আবেদন। তাঁর বাঁশির সুরে উত্থিত হয়েছে পল্লিজীবনের অবহেলিত তুচ্ছ প্রাণ থেকে শুরু করে মা-মাটির বেদনার সুর, অনুরাগের সুর। যে সুর বাংলা তথা বাঙালির প্রাণের সুর।
আধুনিককালের পথিক হয়েও আধুনিক চিন্তা-ভাবনার জট ভেদিয়ে- চারিত্রিক সরলতা, মানবীয় আবেদন, মুগ্ধ নিরাভরণ, গ্রাম্য নর-নারীর জীবনের সরল রূপের প্রতি আকর্ষণ তাঁর মানসে অনন্য মাত্রা প্রদান করেছে, যেটার প্রমাণ মেলে তাঁর রচিত ‘রাখালী’ ‘সকিনা’ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ‘ধানক্ষেত’ ‘বালুচর’ ‘মাটির কান্না’ ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’সহ বহু কাব্যগ্রন্থে।
“রাখালী” ছাত্রাবস্তাতেই তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এখানে তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলত্ব। এই কাব্যের অন্তর্গত ‘কবর’ কবিতাটি কল্লোলের পাতায় প্রকাশিত হলে, প্রশংসা করে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন- “একটি কবিতা গেঁয়ো মাঠের সজল শীতল বাতাসে উড়ে এসে ‘কল্লোলে’ মানুষের মনে সংক্রমিত হওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে সকলের মনকে দ্রবীভূত করে।”
এখানেই তাঁর কাব্যসাধনা ও পরিচিতির সফল সূচনা। কোনো কল্পলোকে নয়, জীবনকে প্রত্যক্ষ করে অজস্র উপমা, অনুপমে গ্রামবাংলা ও বাঙালির স-ছন্দ অবতরণে সাধারণ লোকের সহজ-সরল কর্ম নিত্যতা, প্রেম-বিরহ, বিশ্বাস-সংস্কার, দারিদ্র্য, হাসি-কান্না, মৃত্যু-শোক, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারই দলিল “রাখালী” কাব্য।
“নক্সী কাঁথার মাঠ” কাব্যপর্যালোচনায় দেখা যায়, পল্লির পটভূমিতে রচিত দুটি গ্রাম্য ছেলেমেয়ের প্রেমের উন্মেষ, বিকাশ ও বিষাদজনক পরিণতির চিত্র আঁকতে গিয়ে পল্লির প্রাকৃতিক দৃশ্য, সামাজিক আবেষ্টনী, কুসংস্কার, অন্ধতা, অদৃষ্টবাদের কর্মধারা ও প্রতিদিনকার ঘরকন্নার বাস্তব ও জীবন্ত ছবি এঁকেছেন। পল্লিজীবন থেকে গৃহীত সুন্দর তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। এ কাব্যের প্রেমচিত্র যেমনি গ্রামবাংলার দলিল, তেমনি গ্রাম্য আচার-অনুষ্ঠান, কলহ-বিবাদ, জমি নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ফসল তোলা, মামলা ইত্যাদির বাস্তব বর্ণনা দিয়েছে। এর প্রতিটি দৃশ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ, বাস্তবধর্মী কবিত্বময়।
“সকিনা” কাব্যের সকিনা সাজু ও ফুলির পরিণত রূপ। প্রৌঢ়া সকিনার জটিল প্রেমভাবনা। সংসারের নানা মিথ্যা, সংস্কার, সংশয়, কণ্টকিত শ্বাসরোধকারী নির্মম বাস্তব পরিবেশে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব নৈরাশ্যে জর্জরিত মানুষের বাস্তব প্রেমের অম্লমধুর চিত্র অঙ্কন করেছেন।
“মাটির কান্না” কাব্যে কবি যুগজীবন জিজ্ঞাসায় চঞ্চল। এখানে জীবনকে দেখা হয়েছে দেশকাল বিধৃত জটিল সম্পর্কের ভিত্তিতে। মানুষের যুগ-যুখান্তরব্যাপী শোষণ, লাঞ্ছনা ও অপমানের পুঞ্জীভূত বেদনা, সামাজিক বৈষম্যের অভিশাপ, স্বার্থপরতা ও নিপীড়িত মানুষের অসহায়ত্ব প্রত্যক্ষ করে কবির মনে জেগেছে বলিষ্ঠ প্রতিবাদস্পৃহা।
“বালুচর” এই কাব্যে তিনি প্রকাশ করেছেন আপন হৃদয়ের অনুরাগ, প্রেম, সৌন্দর্যবোধ, হতাশা, নৈরাজ্য, মমত্ব। বালুচরের আকর্ষণে মনপ্রাণ বাঁধা পড়ায় বলেছেন-
“বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে
কেমনে পশিব গোধন লইয়া গাঁয়ের ঘরে।”
“ধানক্ষেত” কাব্যটি চাষি জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। যেখানে অতি সাধারণ পরিপাশ্বিক বিষয় কবির কল্পনায় অসাধারণ মাধুর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি সবুজ ধানের আকর্ষণে বলেছেন-
“ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলো শুয়ে মাঠের পরে।”
ড. দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে পালা সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রামীণ জনগণের আনন্দ-বেদনার জীবনগাঁথার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়ে তিনি রচনা করেছেন গাঁথাকাব্য “সোজন বাদিয়ার ঘাট।” এটি সর্বাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত বাংলা বই। যেখানে সুনিপুণে অঙ্কিত করেছেন সোজন ও দুলীর অপূর্ব প্রেমচিত্র। অঙ্কন করেছেন হিন্দু মুসলমানের দ্ব›দ্ব-কলহ, এবং অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। হিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠুরতার আলেখ্য। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “তোমার ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অতীব প্রশংসার যোগ্য। এই বই যে বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে, সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই।”
তাঁর ভান্ডারে পল্লি-মৃত্তিকা ঘনিষ্ঠ অলংকার ও মেঠো ফুল ভিন্ন কোনো হীরা-মণি-মুক্তা নেই, আবেগের মধ্যে কোনো সাগর সংগীত নেই, কিন্তু তাঁর যা আছে তা অন্য কারো নেই। লোকজীবন ও লোক ঐতিহ্য থেকে কাব্যের বস্তুসম্পদ আহরণ করলেও চৈতন্যে ও মননে তিনি একজন শুদ্ধ আধুনিক কবি। বাংলা সাহিত্যে নিতান্ত পল্লিবাসীদের সুখ-দুঃখ জীবনভাবনাকে নতুন করে আমাদের কাছে স্ব-ভাবে উপস্থাপন করায় যে নবতর সাহিত্য গড়ে উঠেছে তা বাংলা কাব্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে।