পর্যটনের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই রাঙামাটিতে

13

এম কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি

পার্বত্যজেলা রাঙামাটির পর্যটনের উন্নয়নে একাধিক মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও কার্যত তার কোন বাস্তবায়ন নেই। ২০১৭ সালে এ জেলায় বিশেষ পর্যটন জোন গঠনের লক্ষে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জেলা পরিষদের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। এ লক্ষ্যে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সম্ভাব্য যাচাই ও জরিপ শেষে একই বছরের ২৯ মে এর মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে ১২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দাখিল করে জেলা পরিষদ। কিন্তু প্রকল্পটি আজও মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি।
এছাড়াও রাঙামাটিতে পর্যটনের উন্নয়ন নিয়ে আরেকটি পৃথক মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ইতোমধ্যে জেলায় পর্যটন উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা বা মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নে কাজ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অনলাইন জুম অ্যাপের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এক সভায় তথ্য প্রকাশ করে ট্যুরিজম বোর্ডের ফোকাস গ্রুপ ডিসকাজন (এফজিডি)।
এতে বলা হয়েছিল, ট্যুরিজম বোর্ডের মাস্টার প্ল্যান প্রজেক্ট টিমের সদস্যরা রাঙামাটি সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার পর্যটন সম্ভাবনার এলাকা ও স্পট সরাসরি পরিদর্শন করে প্রকল্প চূড়ান্ত করছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। প্রকল্পে ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু এ প্রকল্পটিও বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
জানা যায়, রাঙামাটিতে বিশেষ পর্যটন জোন গঠনে প্রকল্প চূড়ান্ত করতে ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি জেলা পরিষদ একটি সেমিনারের আয়োজন করে। তৎকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। এতে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকসহ প্রকৌশলী, উন্নয়ন সংগঠক ও বিভিন্ন পর্যায়ের সামাজিক নেতা। সেমিনারে সদরসহ জেলার ১০ পয়েন্টে পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের জন্য তৈরি করা নক্শাসহ একটি মহাপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়েছিল, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারকে ১২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনাটির সঠিক বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে খসড়া পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাঙামাটি শহরের ফিশারিঘাট থেকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সংযোগ সড়কের দুই পাশে পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের গ্যালারি নির্মাণ, উভয় দিকের আশপাশের দ্বীপগুলোকে সংযুক্ত করতে আধুনিক মানের ক্যাবল ব্রিজ নির্মাণ ও ক্যাবল কার সংযোগ স্থাপন, কাপ্তাই হ্রদে ভাসমান টিলাগুলোতে রেস্টুরেন্ট ও গেস্ট হাউস নির্মাণ, শহরের পর্যটন মোটেল এলাকায় আধুনিক মানের বিনোদন স্পট, সুইমিং পুল, ক্যাবল কার সংযোগ স্থাপন, প্যাডল বোট, ওয়াটার ট্যাক্সি চালু, শহরের জিরো পয়েন্টের লাভপয়েন্ট স্পট উন্নয়ন, লুসাই পাহাড়ে আবাসিক গেস্ট হাউস নির্মাণ, বালুখালী হর্টিকালচার এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার ও ক্যাবল ব্রিজ নির্মাণ, শহিদ মিনার এলাকায় ৪০ কক্ষের একটি আবাসিক হোটেল নির্মাণ, সুবলং ঝরনা স্পট উন্নয়ন, নির্বাণপুর বৌদ্ধ বিহার স্পট উন্নয়ন, শহরের প্রবেশমুখ মানিকছড়ি এলাকায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে গ্যালারি স্টেট ভিউ সাইট, ঘাগড়ায় ক্যাফেটরিয়া এবং কাপ্তাই নতুনবাজার এলাকায় থ্রি স্টার হোটেল নির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। রাঙামাটিকে আধুনিক ও মডেল পর্যটন জোনে রূপ দিতে ওই মহাপরিকল্পনাটির তৈরি। যা বিপুল সম্ভাবনার রাঙামাটি অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং লেক ও পাহাড়ের সৌন্দর্য্যমন্ডিত প্রকৃতি তুলে ধরতে হাতে নেয়া হয়েছে। ৬০ লাখ টাকায় চুক্তিভিত্তিক একটি কনসালটেন্সি ফার্ম নিয়োগ করে মাস্টার প্লানের নকশা তৈরির কাজ করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু গত ৬ বছরেও প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় এ মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হতে পারেনি।
এ বিষয়ে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, সম্ভাবনাময় রাঙামাটি পার্বত্য জেলার পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে ‘অ্যাক্সক্লুসিভ পর্যটন জোন’ গঠনে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। এটির নক্শা ও খসড়াসহ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০১৭ সালের ২ মে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। তার আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রাঙামাটি শহরের পলওয়েল স্পটে ‘লাভপয়েন্ট’ স্থাপন দিয়ে ‘অ্যাক্সক্লুসিভ ট্যুরিজম জোন’ স্থাপনার কার্যক্রম শুরু হয়। রাঙামাটির বিশেষ পর্যটন জোন গঠনের প্রকল্পটি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় যাচাই-বাছাইয়ে রয়েছে। অনুমোদন পেলে বাস্তবায়ন শুরু করা হবে।
জানা যায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার পর্যটন মহাপরিকল্পনার বিষয়ে তাদের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। তাদের ওই অনলাইন জুম অ্যাপ সভায় রাঙামাটির পর্যটন সম্ভাবনার বিভিন্ন এলাকা ও স্পটের বর্ণনা ও বিষয়বস্তু তুলে ধরে ট্যুরিজম বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে জাতীয় পর্যায়ে রাঙামাটি জেলার বড় ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দ্রুত জীবনমান পাল্টে যাবে। দেশে বিদেশে এ পার্বত্য জেলার বিশাল পরিচিতি ঘটবে।
এ সময় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ বলেন, রাঙামাটি হচ্ছে বাংলাদেশের অত্যন্ত সুন্দর ও নৈসর্গিক জেলা। সেখানকার বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠী মানুষের জীবনধারা ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি আরও বেশি আকর্ষণীয়। কাপ্তাই লেক, পাহাড়, বন, ঝরনায় পরিবেষ্টিত রাঙামাটি জেলা পর্যটনের জন্য অপার সম্ভনাময়। সেখানে পর্যটনের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা হলে জাতীয়ভাবে অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনা প্রচুর। এসব বিষয় চিন্তা করেই রাঙামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন নিয়ে মহাপরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাঙামাটির পর্যটন উন্নয়নে এ মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রকল্প চূড়ান্ত হয়নি। প্রকল্প চূড়ান্ত হলেই ডিপিপি অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে দাখিল করা হবে।