পর্যটনের অপার সম্ভাবনা সত্ত্বেও পিছিয়ে চট্টগ্রাম

78

মনিরুল ইসলাম মুন্না

দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। পাহাড়, টিলা, লেক, সমুদ্র আর বৈচিত্রপূর্ণ গাছগাছালি সমৃদ্ধ এ অঞ্চল পর্যটকদের বরাবরই হাতছানি দেয়। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদে পরিপূর্ণ অঞ্চল দেশে আর কোথাও নেই। আর এ অঞ্চলটি হতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। তারপরও নানা প্রতিক‚লতায় পিছিয়ে রয়েছে পর্যটনের এই বিশাল খাত।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান এনডিসি পূর্বদেশকে বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পর্যটকদের সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করার পাশাপাশি। সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে।
জানা যায়, বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। তাদের ৭৫ শতাংশ এখন ভ্রমণ করেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও সারা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন মার্কেটের অন্যতম। পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরের যেমন- পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগব্যবস্থা থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যে কোন বড় শিল্প থেকে পাওয়া রাজস্ব আয়ের চেয়ে শতগুণ বেশি। দেশে পর্যটন শিল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন শিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে প্রতিবছর এক কোটি পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করে থাকেন। চট্টগ্রাম জেলার পর্যটন এলাকার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলা এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে এখনো অনেক স্থানে থাকা-খাওয়ার সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট দেশ মালদ্বীপের পর্যটন খাতে আয় অনেক বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে কয়েক মাইল পরিধির টোগো দ্বীপ পর্যটন খাতে প্রতিবছর বাংলাদেশী টাকায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় করছে আর বাংলাদেশে এ খাতে যে আয় হয়ে থাকে তা অতি নগণ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে শুধু কিছু হোটেল-মোটেল নির্মাণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। পর্যটকদের যাতায়াত, নিরাপত্তা, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ সবকিছুর সু-বন্দোবস্ত থাকা আবশ্যক। শহর, নগরগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। তাহলেই কেবল পর্যটন খাতে ভালো ভবিষ্যতে আশা করা যেতে পারে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলেও মনে করে থাকেন অনেক পর্যটক। এখানে বেড়াতে এসে দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন অনেকে। কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে গোসলে গিয়েও প্রাণ হারান পর্যটকরা। তাই স্বাচ্ছন্দপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। তাছাড়া যেসব স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। একই সাথে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশের অনূকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বিদেশি পর্যটক ছাড়াও অভ্যন্তরীণ পর্যটন বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা করার সময় এসেছে। এ জন্য বিভিন্ন স্পট তৈরি করে আনুষঙ্গিক সুবিধা জোরদার করতে হবে। আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতটি কোথাও কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে কক্সবাজার নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা। সম্পতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগর পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের পর্যটক বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটন আকর্ষণে কক্সবাজারে আসে। বর্তমানে কক্সবাজার জেলায় তিনটি ট্যুরিজম পার্কের কাজ করছে সরকার। তা হল- সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। ইতিমধ্যে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক চালু হয়েছে।
বাংলাদেশের আরেকটি পর্যটন এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম। এটা বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের এলাকা যা তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এ যেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলের খেলা। এখানে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে শীত এক রূপে ধরা দেয়, কিন্তু বর্ষায় ধরা দেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপে। শীতে পাহাড় কুয়াশা ও মেঘের চাদরে ঢাকা থাকে। তার সাথে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চার দিকে সবুজের সমারোহ। এ সময় প্রকৃতি নতুন যৌবন ফিরে পায়। বর্ষায় মূলত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ট্যুরিস্টদের পদচারণায় বেশি মুখর থাকে এ পার্বত্যাঞ্চল। তখন এখানে ঝর্ণা, হ্রদ কিংবা নদীপথগুলো নতুন রূপে সেজে ওঠে যা দেখার জন্য অসংখ্য পর্যটক এখানে ভিড় করেন।
কলেজ অধ্যক্ষ মো. আবু তালেব বেলাল বলেন, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সব পক্ষকে নিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। দেশিয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটনে শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান এনডিসি পূর্বদেশকে বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকে চট্টগ্রামকে পর্যটনের অন্যতম ক্ষেত্র বলা যায়। এখানে সমতল ভূমির পাশাপাশি পাহাড়, সমুদ্র, লেক ও ঝর্ণার মত আকর্ষণীয় নানা জায়গা রয়েছে। এখানে পর্যটকদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তাসহ যাবতীয় বিষয়াদি তদারকিতে ট্যুরিজম বোর্ড রয়েছে। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। পৃথিবীর যে কোন পর্যটককে আকৃষ্ট করার মত সকল পর্যটন আকর্ষণীয় উপাদান বাংলাদেশে বিদ্যমান। অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশ্যে ট্যুরিজম বোর্ড গঠন করেছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদারে ট্যুরিস্ট পুলিশ সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র কক্সবাজারকে প্রধান্য দিয়ে বিমানবন্দরের রানওয়েকে সম্প্রসারিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি কক্সবাজার যাতায়াতে রেল ও সড়কপথেও সমান গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত পর্যটকদের সব রকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, পর্যটকদের সুবিধার জন্য সব ধরনের কাজ করছে ট্যুরিজম বোর্ড। পাশাপাশি আমাদের পক্ষ থেকেও পর্যটকদের প্রয়োজনে যা যা দরকার তার সবই ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোই সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। যেমন- কক্সবাজারের সাবরং ট্যুরিজমকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এতদিন মহামারি থাকার কারণে একটু পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে প্রচার প্রসারের কাজ চলমান রয়েছে। অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোও পর্যটকদের সকল সুযোগ সুবিধা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।