পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক প্রভাব জনজীবনে

39

মনিরুল ইসলাম মুন্না

প্রতিদিন নগরীতে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মানুষের কার্যকলাপের কারণে দূষণের পরিমাণ দিন দিন যে হারে বাড়ছে এতে মানুষকে দূষণকবলিত পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে। দূষণের চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ দূষণজনিত কারণে রোগাক্রান্ত বা মারা যাচ্ছে। দূষণের মধ্যে বায়ু ও শব্দদূষণ নগরজীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলছে। এতে সাধারণ মানুষ নানা রোগের শিকার হচ্ছে। আর এর বেশিরভাগই হচ্ছে রাস্তায় কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্য।
এদিকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ আর বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা আছে। এ নিয়ে ২০২১ সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীর আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা নিয়ে জরিপ চালায় পরিবেশ অধিদপ্তর। এলাকাগুলোতে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দের তীব্রতা পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। ১৪টি স্পটে শব্দের মাত্রা পওয়া গেছে ৬৭ দশমিক ৬ থেকে ৮০ দশমিক ৫ ডেসিবল পর্যন্ত, যা নির্ধারিত মাত্রার বেশি। আবাসিক এলাকার সাতটি স্পটে করা জরিপে দক্ষিণ খুলশী এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৭৮ দশমিক ৫ ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার সামনে সর্বনিম্ন ৬৭ ডেসিবল। জরিপে বাণিজ্যিক এলাকার ছয়টি স্পটের মধ্যে নগরীর জিইসি মোড়ে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৯৭ দশমিক ৫ ডেসিবল আর সর্বনিম্ন ছিল অক্সিজেন মোড়ে ৭৭ দশমিক ৫০ ডেসিবল। এছাড়া সিইপিজেড মোড়ে ৮৯ দশমিক ৫, আগ্রাবাদ মোড়ে ৮৮, একে খান মোড়ে ৮৬ দশমিক ৫, বহদ্দারহাট মোড়ে ৮৪ দশমিক ৫ ও অক্সিজেন মোড়ে ৭৭ দশমিক ৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দদূষণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ আইনে যেসব এলাকায় আবাসিক ভবনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলোকে ‘মিশ্র এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের দুটি এলাকার মধ্যে নগরীর মুরাদপুর ও মেহেদীবাগ এলাকায় শব্দের মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৫ ও ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবল। যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রখর রোদ, কনকনে ঠান্ডা বা টানা বৃষ্টির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তা সামাল দেয়া, অবৈধ কোনো গাড়ি চলে যাচ্ছে কি না তা নজরে রাখা এবং যানজট নিয়ন্ত্রণে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জ্বর, সর্দি-কাশি ও বিভিন্ন ব্যথাজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। শুধু জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত (৮ মাসে) ৮৫ জন ট্রাফিক পুলিশ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
হাসপাতালের দেয়া তথ্যমতে, ট্রাফিক সদস্যরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সকাল বিকেল ডিউটি করেন। এতে তারা মানসিকভাবে চাপ অনুভব করেন। কেউ কেউ অতিরিক্ত গরম সহ্য করতে না পেরে মাথা ঘুরে পড়ে যান। আবার অনেকে কোমর ব্যথা, মাথা ব্যথা, ঘাঁড় ব্যথা, হাত-পা ব্যথাসহ অন্যান্য ব্যথায় আক্রান্ত হন। পাশাপাশি রয়েছে পরিবহন ও আশপাশের পরিবেশের নানা প্রকারের শব্দদূষণ। এছাড়া বয়স্ক কিছু পুলিশ সদস্য রয়েছেন, যাদের হার্টেও রয়েছে নানা সমস্যা। যার কারণ হিসেবে রয়েছে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ধূলোবালি। এসব থেকে প্রথমে কাশি এবং পর্যায়ক্রমে ক্যান্সারে পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছেন এসব সদস্যরা।
তেমনই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের গত ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) মুন্সি হাফিজুর রহমান ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, চার বিভাগে উপ-পুলিশ কমিশনার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সদস্য রয়েছেন ১৮৫২ জন। এরমধ্যে রয়েছেন চার ডিসি (উপ-কমিশনার), চার এডিসি (অতিরিক্ত উপ-কমিশনার) এবং চার এসি (সহকারী কমিশনার)। এছাড়াও ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) ২৯ জন, সার্জেন্ট ৩৮০ জন, এসআই ৮ জন, টিএসআই ৮ জন, এএসআই ১৫ জন, এটিএসআই ১০৬ জন এবং কনস্টেবল রয়েছেন ১২৯০ জন। তাদের বেশিরভাগ সদস্য অতিরিক্ত শব্দদূষণের মধ্যে ডিউটি করার ফলে খিটখিটে মেজাজের হয়ে যান। পরিবারের কেউ কিছু বললেই তাৎক্ষণিক রেগে যান।
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের বেশিরভাগ সদস্যের প্রায় সময় প্রচন্ড মাথাব্যথা করে, রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। বাসায় গিয়ে বিনা কারণে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে খিটখিটে মেজাজ দেখান। কারো কারো শ্রবণশক্তি এবং স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, পেপটিক আলসার, উৎকণ্ঠা ও অমনোযোগী ভাব দেখা দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের এক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) জানান, শব্দদুষণের কারণে তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। রাস্তায় ডিউটি শেষ করে বাসায় গেলে মেজাজ থাকছে খিটখিটে। পরিবারের লোকরা মনে করেন তিনি হয়তো কোনো কারণে তাদের ওপর বিরক্ত। রাস্তায় ডিউটি করার কারণে পরিবারে গিয়েও তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে হচ্ছে। কারণ তার মনে হচ্ছে রাস্তায় ডিউটি করছেন। এমনকি পরিবারের সঙ্গে টেলিভিশন দেখতে গিয়েও সাউন্ড বাড়িয়ে দেখছেন, এতে পরিবারের অন্যদের সমস্যা হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে অনেক সময় জেগে যাচ্ছেন। শুধু তিনি নন, নগরীর সকল ট্রাফিক সদস্য কম-বেশি কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত। সাধারণভাবে কোনো সমস্যা দেখা দিলে নিকটবর্তী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। বড় কোনো সমস্যা না হওয়া পর্যন্ত তারা এভাবেই চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক সদস্যের স্ত্রী পূর্বদেশকে বলেন, সারাদিন ডিউটি করে এসে কেমন জানি হয়ে যায়। সকালে যাওয়ার সময় এক ধরনের আচরণ আবার ডিউটি করে এসে আরেক রকমের আচরণ করে। আবার মাঝে মাঝে রাতের বেলায় ডিউটি করতে গেলে ফেরার কোনো সময় থাকে না। ফোন করে কিছু জানতে চাইলে উল্টো রেগে যায়।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডা. আহমেদ রসুল পূর্বদেশকে বলেন, শব্দদূষণে মূলত সব ট্রাফিক সদস্যের কানের সমস্যা হয়। এছাড়া মানসিকভাবে সব সময় ঝামেলায় থাকতে হয়। সড়কে ডিউটিরত ট্রাফিক সদস্যদের সবসময় স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হয়। এ কারণে স্বাভাবিক কাজকর্মে মন বসানোও কঠিন হয়ে যায়। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে।
তিনি জানান, শব্দদূষণের কারণে খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করা যায় না। খাওয়ায় অরুচি হয়। স্বাভাবিক শব্দের চাইতে বেশি ডেসিবলের শব্দ সবসময় ট্রাফিক সদস্যদের চারপাশে হচ্ছে। এছাড়াও তাদের কানের পর্দা ফেটে যাওয়া, হিটস্ট্রোক, মাইগ্রেন সমস্যা, ঘুম না হওয়া, আমাশয়, পাতলা পায়খানাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন অপারেশনকৃত রোগীকেও চিকিৎসা দিচ্ছি।
ডা. আহমেদ রসুল আরও বলেন, ছোটখাটো কোনো সমস্যায় আমাদের এখানে তেমন রোগী আসেন না। বড় কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমরা ভালমত পরীক্ষা করে সেবা প্রদান করি। যারা কানের সমস্যায় আসছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ট্রাফিক সদস্য, গাড়িচালক ও কল সেন্টারে (কানে হেডফোন লাগিয়ে যাদের ডিউটি) কাজ করেন। এদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। যেসব রোগী আসেন তাদের বেশিরভাগ কানে কম শুনতে পাওয়া, জ্বর, সর্দি-কাশি, কানে শব্দ হওয়া, মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ করা, মাথা ব্যথা, শারীরিক অবসাদ ও রাস্তা পার হতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা রোগীরা শেয়ার করছেন। এছাড়া সড়কে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পানি ঠিক মতো পান না করার কারণে কিডনি সমস্যাও হচ্ছে তাদের।
ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এনএম নাসিরুদ্দিন বলেন, ট্রাফিক সদস্যদের মানসিকভাবে সবসময় ঝামেলায় থাকতে হয়। সড়কে ডিউটিরত ট্রাফিক সদস্যদের স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত শব্দ দূষণের মধ্যে থাকতে হয়। এ কারণে স্বাভাবিক কাজকর্মে মন বসানোও কঠিন হয়ে যায়। মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে তাদের। ট্রাফিক সদস্যদের চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ার আগেই নানা রোগে আক্রান্ত হন।
ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন পূর্বদেশকে বলেন, সড়কে ৮ ঘণ্টা ডিউটির পরে অনেকের মাথাব্যথা ও রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, জ্বর ও ক্ষুধামন্দার মতো সমস্যার কথা বলে থাকেন।
পরিবেশ দূষণ নিয়ে কাজ করা সচেতন তরুণ প্রজন্ম সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক ম. মাহমদুর রহমান শাওন বলেন, রাস্তা-ঘাটে অতিরিক্ত হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার ও বায়ু দূষণের ফলে জনজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবহনের প্রতিযোগিতামূলক আচরণ বন্ধ না হলে তা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। এসব পুলিশ প্রশাসন বা পাবলিক একা কখনো বন্ধ করতে পারবে না। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতার ফলে শব্দদূষণ তথা পরিবেশ দূষণ রোধ করা যাবে।